জাতীয় পার্টিতে চ্যালেঞ্জের মুখে জিএম কাদেরের নেতৃত্ব
১৩ জানুয়ারি ২০২৪চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ছাড়াই রোববার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে সভা ডেকেছেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহনকারী পার্টির এমপি প্রার্থীরা৷ একদিন আগে এই সভার বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি দিলেও এখন মহাসচিবের কন্ঠে নরম সুর৷ এই সভাকে তিনি স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন৷
এমন পরিস্থিতি জাতীয় পার্টি আরেক দফা ভাঙনের মুখে পড়তে যাচ্ছে কি না সেই প্রশ্ন উঠাও স্বাভাবিক৷ এর আগেও ৫ বার ভেঙেছে দলটি৷
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শনিবার চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু দলের নেতাদের নিয়ে ঘরোয়া বৈঠক করেছেন৷ ওই বৈঠকে প্রেসিডিয়ামের অধিকাংশ নেতাই উপস্থিত হননি৷ এমনকি গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোন নেতা সেখানে ছিলেন না৷
বিদ্রোহের বিষয়ে জানতে চাইলে মুজিবুল হক চুন্নু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা বিদ্রোহ না৷ দল ছেড়ে অনেকেই চলে যেতে পারেন৷ কিন্তু জিএম কাদের যেখানে থাকবেন সেটাই আসল জাতীয় পার্টি৷ আমি চুন্নু আলাদা দল করলে কী সেটা জাতীয় পার্টি হবে? হবে না৷’’
রোববার যে বৈঠক ডাকা হয়েছে সেটা কী আপনাদের অনুমতি নিয়ে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘না, আবার আলোচনাও করেছে৷ তারা তো আমাদের দলের নেতাকর্মী৷ ফলে করুক না আলোচনা৷’’
আগে তো হুশিয়ারি দিয়েছিলেন, এই সভা অগঠনতান্ত্রিক৷ এখন কী বলবেন? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘দলের স্বার্থে কখনো কখনো ছাড় দিতে হয়৷ সবকিছু কঠোরভাবে দেখা যায় না৷’’
দলের শীর্ষ দুই নেতাকে হুট করে অব্যহতি দেওয়া ঠিক হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘তারা হয়ত এমন কিছু করেছেন যা চেয়ারম্যান নিশ্চিত হয়েছেন৷ ফলে সেখানে ছাড় দেওয়ার সুযোগ ছিল না৷’’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল জাতীয় পার্টি৷ এর মধ্যে ২৬টি আসন ছাড় পেয়েছিল আওয়ামী লীগের কাছ থেকে৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাশ করেছেন ১১ জন৷
এমন ফলাফলের পর গত বুধবার প্রথম বনানীতে পার্টি অফিসের সামনে বিক্ষোভ করেন দলের নেতাকর্মীরা৷ বিক্ষুব্ধ নেতাদের ওইদিন পার্টি অফিসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি৷ সেদিনই চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগের দাবিতে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন নেতারা৷ শুক্রবার সেই আল্টিমেটাম শেষ হয়েছে৷
ওই দিনই অর্থাৎ শুক্রবারই পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এবং সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সুনীল শুভ রায়কে অব্যাহতি দেওয়া হয়৷ দলীয় গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের এ অব্যাহতি দেন৷ এতে দলের ভেতরে ক্ষোভ আরও বেড়েছে বলে জানা গেছে৷
হঠাৎ করেই দল থেকে অব্যাহতিতে আশ্চর্য হননি কাজী ফিরোজ রশিদ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মোটেও আশ্চর্য হইনি৷ আপনাদের থেকে আমি বিষয়টি জেনেছি৷ বিষয়টি ঠিক আছে৷ তিনি (জিএম কাদের) ভালো করেছেন৷ তবে এ মুহূর্তে আমি কিছুই বলবো না৷ অনুসন্ধান করলে সব বের হবে৷’’
হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত পার্টির চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ কি না জানতে চাইলে তিনি কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হননি৷
ভোটে ভরাডুবির জন্য দলীয় চেয়ারম্যান জিএম কাদের, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে দায়ী করে এই তিন শীর্ষ নেতার পদত্যাগ দাবি করেন বিক্ষোভকারীরা৷ পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশিদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, লিয়াকত হোসেন খোকাসহ অনেক সিনিয়র নেতা এই বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন৷
এদিকে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি নির্বাচনে ‘ভরাডুবির' পর অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে আছেন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত রওশন এরশাদ-পন্থি নেতারা৷ এখন রওশন এরশাদ-পন্থিদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন নির্বাচনে হেরে যাওয়া প্রার্থীরা৷ তার মধ্যে জাপার অনেক কেন্দ্রীয় নেতাও আছেন৷
বনানী কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ চলাকালে বুধবার লিখিত বক্তব্যে পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, ‘‘নির্বাচনে পার্টির চরম ভরাডুবি হয়েছে৷ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যনের সঙ্গে মনোনয়ন প্রশ্নে প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ নির্বাচন থেকে বিরত ছিলেন৷ কিন্তু তিনি পার্টির মধ্যে বিভক্তি তৈরি হতে দেননি৷ অথচ পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের গত চার বছরে তার সাংগঠনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং অদক্ষতার কারণে জাতীয় পার্টিকে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছেন৷ তারই প্রতিফলন ঘটেছে দ্বাদশ নির্বাচনে৷ পার্টির প্রার্থীদের সঙ্গে চরম বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা করা এবং তাদের এক প্রকার পথে বসিয়ে দেওয়ার জন্য পার্টির দুই শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন বর্জন করেছেন৷ সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে ২৬টি আসনে সমঝোতা করে সেখানেও ভরাডুবি হয়েছে৷ এ পরিস্থিতিতে পার্টির ঐক্য ধরে রাখতে জিএম কাদের এবং মুজিবুল হক চুন্নুকে অবলিম্বে পদত্যাগ করতে হবে৷’’
এ সময় জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, ‘‘৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি৷ আমরা প্রয়োজনে সাংগঠনিকভাবে নিয়মমাফিক কাউন্সিল আহ্বান করব৷ দলের চেয়ারম্যানসহ শীর্ষ নেতাদের প্রসঙ্গে সাবেক এই এমপি বলেন, আমরা শুনেছি তারা টাকা-পয়সা নিয়েছেন৷ এটা সঠিকভাবে তদন্ত করে আমরা ব্যবস্থা নেব৷ দলই যদি সঠিক না থাকে, তা হলে আসন পেলাম কি পেলাম না, সেটা প্রশ্ন নয়৷’’
আবু হোসেন বাবলা ঢাকা-৪ আসন থেকে লড়াই করে হেরে যান৷ এই আসনে আওয়ামী লীগ ছাড় দেয়নি জাপাকে৷
বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দল খবর নেয়নি৷ এ কারণে দলের প্রার্থীরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে৷ আমরা রোববার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে বৈঠক করব৷ সেখানে চেয়ারম্যান বা মহাসচিব থাকবেন না৷ পরে আমরা এই ক্ষোভের কথাগুলো পার্টির সর্বোচ্চ ফোরামে আলোচনা করব৷ এটাকে আমি বিদ্রোহ বলছি না৷ আবার আমরা ভাঙন চাই না৷ যোগ্য নেতৃত্বে পার্টি আরও শক্তিশালী হোক সেটাই আমাদের চাওয়া৷ আপাতত এটুকুই৷’’
দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন জাপার কেন্দ্রীয় কয়েক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘জিএম কাদেরসহ বেশ কয়েকজন নেতা দলটিকে ধ্বংস করে দিয়েছে৷ এক পরিবার থেকেই জিএম কাদের নিজে, তার স্ত্রী-ভাগ্নেসহ অনেক আত্মীয়-স্বজন এবং কিছু চামচা এই সমঝোতার সংসদ সদস্য হতে চেয়েছেন৷ আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীসহ অনেকের বিষয় তো আপনারা জানেন৷ এরা মিলেই তো দলকে শেষ করে দিয়েছে৷ এরা তো পার্টির চাঁদার টাকাও মেরে খায়৷ এই নির্বাচনে পার্টির নমিনেশন বিক্রি হয়েছে সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা৷ অনেক শুভাকাঙ্খী পার্টিতে টাকা দেয়, সেই টাকাও তারা মেরে খায়৷ এরা তো জাতির সাথেই বেঈমানি করেছে৷’’
জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নির্বাচনে আমাদের যে বিপর্যয়টা হয়েছে, সেখানে তো আমাদের ব্যর্থতা আছে৷ পার্টির নেতারাও এর দায় এড়াতে পারেন না৷ আমাদের সঙ্গে জোটে যে সমঝোতা হল সেখানে আমরাও নির্বাচন করলাম, আবার আওয়ামী লীগের নৌকা না থাকলেও তাদের প্রার্থী থাকল৷ ফলে আওয়ামী লীগের লোকজন আমাদের পক্ষে কাজ করল না৷ অন্যদিকে আমরা সরকারের জোটে থাকায় বিরোধীদের কাছে ভোট চাইতে যেতে পারিনি৷ ফলে বিষয়টি আগেই পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন ছিল৷ আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা যাওয়ার দরকার ছিল৷ ২০০৮ সালে বা ২০১৮ সালে তো আমরা সেভাবেই নির্বাচন করেছিলাম৷ ফলে যে বিপর্যয়টা হয়েছে সেখানে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক৷ আমি মনে করি, পার্টির দায়িত্বশীল নেতারা তাদের সঙ্গে কথা বললে তাদের ক্ষোভ প্রশমন হবে৷''
হঠাৎ করেই সিনিয়র দুই নেতাকে অব্যহতি দেওয়াকে কীভাবে দেখেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, চেয়ারম্যানকে যারা বুদ্ধি দিয়েছেন তারা সঠিক বুদ্ধি দেননি৷ এই সিদ্ধান্তটা এভাবে না আসলেই ভালো হতো৷’’
প্রসঙ্গত, জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের অবর্তমানে এবারই প্রথম দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দলটি৷ ২৮৩ আসনে প্রার্থী, ২৬ আসনে সমঝোতা হলেও নির্বাচিত হন দলের মাত্র ১১ জন৷
এর আগে, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল হিসেবে ২৭টি আসনে জয় পেয়েছিল জাতীয় পার্টি৷ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জেনারেল এরশাদ প্রাথমিকভাবে অংশগ্রহণ করতে না চাইলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সাথে থাকতে হয়েছিল৷ এরপর সমঝোতার মাধ্যমে ২০১৪ সালে ২৯টি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২২টি আসনে জয়লাভ করে দলটি৷ সে সময় দলটির নেতাদের অনেকের কথায় সেই সমঝোতা নিয়ে অস্বস্তি চাপা থাকেনি৷ তখন দলটিকে ঘিরে নানা ধরনের তৎপরতাও দেখা গিয়েছিল রাজনৈতিক অঙ্গনে৷