জাতিসংঘের অধীনে তদন্তের তাগিদ, জাতিসংঘের সহযোগিতার আশ্বাস
২ আগস্ট ২০২৪চলতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের সঙ্গে ‘অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি” আলোচনা স্থগিত করেছে ।
সেপ্টেম্বরে নতুন অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরুর কথা ছিল। ইইউর পররাষ্ট্র বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ জোসেফ বোরেল ফন্টেলেস ৩০শে জুলাই এক বিবৃতিতে আলোচনা স্থগিত রাখার কথা জানান।
অন্যদিকে ৩০ জুলাই ঢাকায় জার্মান রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন গণভবনে দেখা করে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও প্রাণহানির তদন্তে জার্মানির সহযোগিতার ইচ্ছার কথা জানান। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুষ্ঠু ও মানসম্মত তদন্ত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির জন্য বিদেশি প্রযুক্তিগত সহায়তা নেয়া হবে।” বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনও তদন্তে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
বুধবার প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তদন্তে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তা চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ," আমরা জাতিসংঘের কাছেও আবেদন করেছি। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে দেশে-বিদেশে, তাদের কাছেও আমরা সহযোগিতা চাই যে, এই ঘটনার যথাযথ সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং যারা এতে দোষী, তাদের সাজার ব্যবস্থা হোক।”
জানা গেছে, সরকার তদন্তে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে টেকনিক্যাল সহায়তা নিতে চায়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংবাদ মাধ্যম এ পর্যন্ত ২১০ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে। আন্দোলনের সময় সরকারি সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সরকার আদালতের নির্দেশনায় এরই মধ্যে কোটা সংস্কার করলেও আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, " যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোল চালিয়ে যাবেন।”
সরকার এই ঘটনায় প্রথমে এক সদস্যের একটি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশর করলেও পরে তার সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে তিনজন করা হয়েছে। কর্মপরিধিও বাড়ানো হয়েছে। তারা এখন ১৬ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত যারা নিহত হয়েছেন, তাদের মৃত্যুর কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করবেন। আগে তাদের শুধু ১৬ জুলাই ছয়জন ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া দেয়া হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘ এই ঘটনায় কয়েক দফা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সর্বশেষ প্রতিক্রিয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক এক ব্রিফিংয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, "মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যধিক বলপ্রয়োগের বিষয়ে সামনে আসা নানা প্রতিবেদনের বিষয়েও তিনি শঙ্কিত।”
তিনি বলেন, ‘‘যে-কোনো পরিস্থিতিতে প্রয়োজকোটা সংস্কইউরোন হলে জাতিসংঘ মহাসচিব তার ম্যান্ডেট অনুসারে পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।”
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফরেন পলিসি প্রধান জোসেপ বোরেল বাংলাদেশে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ‘মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের' নিন্দা জানিয়েছেন। বোরেল এক বিবৃতিতে বলেন, "বিক্ষোভকারী ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের অসংখ্য ঘটনাকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।” তার কথা, "মৌলিক অধিকারের প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধা বজায় রাখতে হবে।”
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে বিক্ষোভকারীদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, হতাহতের ঘটনা, নির্বিচার গ্রেপ্তার ও নির্যাতনে গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। এমন ঘটনায় হতাহতদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং স্বচ্ছ তদন্ত চায় সংস্থাটি। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা চিঠিতে ওইসব কথা বলেছেন। তিনি তার চিঠিতে চলমান সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে সবরকম সহায়তা প্রস্তাব করেন। সেখানে তিনি কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সৃষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর স্বচ্ছ তদন্তের তাগিদ দেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশে ছাত্র বিক্ষোভের সময় নিরাপত্তা বাহিনী যে অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করেছে সেগুলোর প্রমাণ রয়েছে তাদের কাছে।বাংলাদেশ থেকে তারা যেসব ভিডিও এবং ছবি পেয়েছে সেগুলোকে তারা যাচাই ও বিশ্লেষণ করছে। এর মাধ্যমে উদ্বেগজনক চিত্র বের হয়ে আসছে। অ্যামনেস্টি আরো বলেছে, "বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি, আবদ্ধ জায়গায় শিক্ষার্থীদের ওপর বিপজ্জনক টিয়ার শেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী একে-৪৭ ধরনের রাইফেল, প্রাণঘাতী অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে।”
সংস্থাটি মনে করে, "পুলিশের প্রতি কোনো হুমকির কারণ ছিল না, এমন ব্যক্তিদের ওপরও ইচ্ছাকৃত এবং অযৌক্তিক আক্রমণ করা হয়েছে।”
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রিন্সিপাল ডেপুটি স্পোকসপার্সন বেদান্ত প্যাটেল সর্বশেষ নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বলেন, "বাংলাদেশে প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগত উভয় ক্ষেত্রেই আমরা বর্তমান পরিস্থিতির স্থায়ী এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার প্রতি আমাদের দৃঢ় সমর্থনের কথা পুনর্ব্যক্ত করছি।”
আর মার্কিন সিনেটর বেন কার্ডিন (ডি-এমডি) এবং কোরি বুকার (ডি-এনজে) কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ছাত্রদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি নিন্দা জানিয়েছেন।
তারা বিবৃতিতে বলেন, "এই ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে একটি আধাসামরিক ইউনিটের কিছু নেতারা ইতিমধ্যেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছেন। আন্দোলনকারীদের ওপর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) বাংলাদেশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নৃশংস শক্তি প্রয়োগ করেছে। বিক্ষোভকারীদের হত্যা এবং হাজার হাজার মানুষকে আহত ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।''
অন্যদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়রে মুখপাত্র লিন জিয়ান মঙ্গলবার নিয়মিত প্রেস কনফারেন্সে বলেন," বাংলাদেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। সব কিছুতে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। এতে বাংলাদেশের বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে চীন আনন্দিত।”
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন," ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ বাংলাদেশের ঘটনাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তারা বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব ও সহযোগিতা চুক্তির আলোচনা স্থগিত করে দেয়ায় সেটাই প্রমাণ হয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী করবে তা এখানো স্পষ্ট নয়।”
তার কথা, " বাংলাদেশকে এখন এই ঘটনার একটা বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করতে হবে। এখন সেটা কতদূর হয় দেখার বিষয়।”
আরেক সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ূন কবির বলেন, "যে ঘটনা ঘটেছে তাতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকার বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এটা কাটিয়ে উঠতে হলে ঘটনার গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবাদের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে।”
"সরকার বিচার ভিাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু রংপুরের যে শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে, সেই মামলায় পুলিশের কথা নেই। অন্যান্য মামলায়ও একই অবস্থা। ফলে স্থানীয় তদন্ত গ্রহণযোগ্য না-ও হতে পারে। তাই তদন্তে জাতিসংঘসহ আর্ন্তাতিক তদন্ত সংস্থাগুলোকে যুক্ত করা ভালো,” বলেন তিনি। তাদের যুক্ত করা হলেও তারা এখানে এসে কতটুকু কাজ করতে পারবেন, তাদের কতটুকু ‘অ্যাক্সেস' দেয়া হবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে বলে মনে করেণ তিনি।
আর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন মনে করেন, ‘‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করলে বোঝা যাবে তারা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন। তাদের কাজের শর্তাবলী এবং যে বিচারকদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের পরিচিতিও সরকারের প্রকাশ করা উচিত।”
অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের একজন হাসিব জামান বলেন, " এই সরকারের অধীনে কোনো তদন্ত বিশ্বাসযোগ্য হবে না। হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তারাই তো তদন্ত করবে। এটা তো হয় না। আমরা জাতিসংঘের অধীনে আন্তর্জাতিক তদন্ত চাই।”
রাজনীতিবিদদের প্রতিক্রিয়া
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, "সরকার এখানে গণহত্যা করেছে। এটা পরিষ্কার মানবতাবিরোধী অপরাধ। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে এই গণহত্যার বিচার করতে হবে। এর সঙ্গে সরকার ও সরকারি বাহিনী জড়িত।”
তার কথা, "এই গণহত্যার তদন্ত জাতিসংঘের অধীনে হতে হবে। এই সরকার তো নিজেই গণহত্যা করেছে। তারা কী তদন্ত কববে! জাতিসংঘের তদন্তের পর বিচার এখানকার ট্রাইব্যুনালে জাসিংঘের তত্ত্বাবধানে হতে হবে।”
এর জবাবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, "সরকার তদন্তে যে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সহায়তা নেবে তা তো প্রধানমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন। এই হত্যাকাণ্ড ও নাশকতার জন্য বিএনপি, জামায়াত দায়ী। তারেক রহমানের নির্দেশে হয়েছে, যার প্রমাণ গোয়েন্দাদের হাতে আছে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, " সরকার এরই মধ্যে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করেছে। স্বচ্ছতার সঙ্গে সব কিছু হবে। এই দেশের আইন এবং আদালতেই হবে, জাতিসংঘের অধীনে নয়। তাদের সহায়তা নেয়া হবে।”