জাতির হৃদয়ে একাত্তরের দেশপ্রেম খুঁজে ফেরেন ডা. মাখদুমা
১১ জুন ২০১১১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে মেডিকেল কলেজের লেখাপড়া শেষ করেন মাখদুমা৷ ইন্টার্নশিপ করে তৎকালীন পাকিস্তানের বিমান বাহিনীতে মেডিকেল কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন৷ কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তিনি৷ ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হিসেবে ছয় দফা, এগারো দফা আন্দোলনসহ সেসময়ের প্রায় সকল আন্দোলন-সংগ্রামে কাজ করেছেন৷ প্রগতিশীল নারীদের নিয়ে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন কর্মী মাখদুমা৷ যে কারণে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান যে অনিবার্য যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে এগুচ্ছে তা যথার্থই অনুধাবন করেছিলেন মাখদুমা এবং তাঁর সংগ্রামী সহকর্মীরা৷ ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য একরকম প্রস্তুতিই নিচ্ছিলেন তাঁরা৷
পহেলা মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দেশবাসীকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়ার ডাক দেন তখন থেকেই নিজ কর্মস্থলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন মাখদুমা৷ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য সভা-সমাবেশ করা এবং অন্যান্য প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে থাকেন৷ ফলে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর আর ঢাকায় থাকা নিরাপদ ছিল না তাঁর জন্য৷ ২৭ মার্চই তাঁর স্বামী ঢাকা ছেড়ে ভারত চলে যান যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য৷ তবে মাখদুমা গোপনে দেশের ভেতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সহায়ক কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন৷ অবশেষে ৩ মে ঢাকা ছেড়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন৷
মুক্তিযুদ্ধের জন্য ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির জন্য যে পৃথক গেরিলা বাহিনী ছিল তাদের শিবিরে গিয়ে হাজির হন মাখদুমা৷ সেখানে চিকিৎসক হিসেবে শরণার্থী এবং আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতে থাকেন৷ এছাড়া যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে উপযুক্ততার সনদ দিতেন৷ এছাড়াও নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সভা-সমাবেশ করতেন৷ মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসে অসংখ্য লোমহর্ষক এবং হৃদয় বিদারক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন৷ সেসব ঘটনার একটি ডয়চে ভেলের কাছে তুলে ধরেন ডা. মাখদুমা৷
তিনি বলেন, ‘‘আগরতলায় শরণার্থী শিবিরের পাশেই একটি ছোট ঘরে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো৷ একদিন দু'টো ছোট ছেলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে সেখানে ঘোরাঘুরি করছিল৷ তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছর হবে৷ আমার সব কাজ শেষ হওয়ার পর তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম যে, কেন তারা সেখানে অনেকক্ষণ ধরে ঘুরছে৷ তখন তারা বেশ কিছুক্ষণ এদিক-সেদিক নানা কথা বলে একটা তালপাতার ঠোঙা বের করে আমাকে দিতে চায়৷ আমি বললাম, এটা আমি কেন নিবো? কী আছে এতে? তারা বলল, তারা মাত্র বাংলাদেশ থেকে এসেছে৷ দেশ থেকে সঙ্গে করে গুড় নিয়ে এসেছে৷ আমি বললাম, এটা তোমাদের কাছেই রাখো৷ তোমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়ার অনেক কষ্ট হবে৷ তারপরও তারা বলল যে, না আপনার ছোট বাচ্চা আছে তাকে এটা দিবেন৷ এরপরও তারা চলে না গিয়ে বসেই আছে৷ তখন জিজ্ঞেস করলাম যে, তোমাদের কি আরও কিছু বলার আছে? তখন তারা জানালো মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের আগ্রহ৷ আমি বললাম যে, ১৮ বছরের কম বয়সের কাউকে তো আমরা যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি না৷ এমনকি ২১ বছরের কম হলেই আমরা নিরুৎসাহিত করতাম৷ কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে অনুরোধ করতে থাকল৷ এমনকি আমার পায়ে ধরার উপক্রম৷ তারা বলল, আমাদের গ্রামে যখন পাক হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা ঢুকল তখন তারা যেভাবে গ্রামের নারী-পুরুষদের উপর নারকীয় নির্যাতন চালিয়েছে, তা আপনি দেখলে আপনার ছোট বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও আপনি যুদ্ধে যেতে চাইতেন৷ তাই আমরা যদি অন্তত একজন পাক সেনাকেও না মেরে মরে যাই, তাহলে এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কিছু থাকবে না৷ নিরুপায় হয়ে আমি আমার ঊর্ধ্বতনদের কাছে ছেলে দু'টোকে নিয়ে গেলাম৷ জানালাম যে, আমার কাছে ছেলে দু'টোকে খুবই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হয়েছে, আপনারা তাদের বিষয়টি দেখুন৷ তবে তারা যে এখন কেমন আছে কিংবা আদৌ বেঁচে আছে কি না জানিনা৷ কিন্তু তাদের চোখে মুখে মাতৃভূমির প্রতি এবং দেশের মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা আমি দেখেছিলাম সেটি আমাকে এখনও আন্দোলিত করে৷ তবে ১৯৭১ আমাদের মাঝে দেশ ও জাতির প্রতি যে ভালোবাসা ও প্রেম জাগিয়েছিল তা কি আমরা পারি না আবারও নিজেদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে?''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক