জনদুর্ভোগ ও ভিআইপি
১২ মার্চ ২০১৯পৃথিবীর এমন আর একটি দেশের নাম জানার চেষ্টা করছি, যে দেশের মন্ত্রী-এমপি-সচিব বা সরকারি অফিসের বড় কর্তাদের বড় বড় গাড়ি রাস্তার উলটো দিক দিয়ে চলে৷ মনে করতে পারছি না৷ জানেন কেউ?
বাংলাদেশে ‘ভিআইপি' শব্দটি বহুল ব্যবহৃত৷ কে ভিআইপি, আর কে ভিআইপি নয়, তা বোঝা বেশ কঠিন৷ প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির চলাচলের সময় অন্য যান চলাচলের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ সাধারণ মানুষ জানেন উনারা ভিআইপি, নিরাপত্তার জন্যে রাস্তা বন্ধ করা জরুরি৷ খুশি না হলেও, মেনে নেন৷
এছাড়া ভিআইপি কারা? তারা কী সরকার নির্ধারণ করে দেওয়া ভিআইপি, না নিজেরা নিজেদের ভিআইপি ঘোষণা দিয়ে নিয়েছে?
ধরে নেই, মন্ত্রী-এমপিরা স্বীকৃত ভিআইপি? এমপিরা আইন তৈরি করেন৷ তাঁরা আইন তৈরি করেছেন, গাড়ি রাস্তার উলটো দিক দিয়ে চলতে পারবে না৷ তাঁরা এমন কোনো আইন তৈরি করেননি যে, তাঁদের গাড়ি উলটো দিক দিয়ে চলতে পারবে৷ কিন্তু তাঁদের অনেকের গাড়ি রাস্তার উলটো দিক দিয়ে চলে৷ সচিব বা সরকারি অফিসের কর্তারা কেন ভিআইপি? তাঁদেরও অনেকের গাড়ি কেন রাস্তার উলটো দিক দিয়ে চলে? প্রশ্নের উত্তর কেউ কখনো দিয়েছেন বলে মনে করতে পারি না৷
বসবাসের জন্যে পৃথিবীর অন্যতম নিকৃষ্ট নগর ঢাকা৷ এমন অপরিকল্পিত নগর পৃথিবীতে আর কয়টি আছে, সেটা কুইজের প্রশ্ন হতে পারে৷ দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের শহরে কোনো গণপরিবহণ নেই৷ যা আছে তা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো৷ যানজট এমন একটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভাষা দিয়ে তা বোঝানো প্রায় অসম্ভব৷
এমন দুর্বিসহ পরিবেশকে প্রতিদিন আরও দুর্বিসহ করে দেয় ‘ভিআইপি'রা৷ রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলো যানজটে আটকে থাকে৷ ভিআইপিরা চলে যায় রাস্তার উলটো দিক দিয়ে৷ উলটো দিক দিয়ে চলতে গিয়ে, সামনে থেকে আসা গাড়িগুলোর গতি কমে যায়৷ ফলে পুলিশ প্রহরায় ভিআইপি চলে গেলে, দুই পাশে গাড়ির জট লেগে যায়৷
ঢাকা শহর যেহেতু মূলত দু'টি প্রধান সড়কের উপর নির্ভরশীল, বাইপাস রাস্তা নেই বললেই চলে৷ ফলে কোনো একটি রাস্তা আটকে বা উলটো দিক দিয়ে ভিআইপিরা চলাচল করলে, পুরো শহরে তার প্রভাব পড়ে৷ রাস্তায় গাড়ি আটকে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷
সম্প্রতি চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেল৷ প্রাণ হারানো ৭০ জন নিয়ে হয়ত বেশি আলোচনা হয়েছে৷ হওয়ারই কথা৷ তবে প্রাণহানির বাইরে যারা পুড়ে গেছেন, যারা সর্বস্ব হারিয়েছেন, কয়েক সেকেন্ডের আগুনের আতঙ্কে যারা ট্রমার মধ্যে আছেন, তাদের কথা তেমন একটা আলোচনা হয় না৷ পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো অতি সরু৷ আগুন লাগলে বা বিপজ্জনক কিছু ঘটলে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি ঢুকতে পারে না৷ যানজট তো থাকেই৷ আশপাশ দিয়ে যদি কোনো ভিআইপি চলাচল করেন, পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো প্রায় সারা দিনের জন্যে জট লেগে থাকে৷ ভিআইপিরা জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি করে চলাচল করেন, দুঃখ লাঘবের কোনো চিন্তা তাদের বিবেচনায় থাকে না৷ বুড়িগঙ্গা নদী দখল করে ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছেন ভিআইপিরাই৷ ঢাকা শহরের ভেতর দিয়ে যেমন ৫৪ টি খালের গল্প শোনা যায়, তেমনি ২০-২৫ বছর আগেও পুরান ঢাকায় অনেকগুলো পুকুর ছিল৷ ভিআইপিরা সেসব পুকুর দখল করে পার্ক বা বিল্ডিং বানিয়েছেন৷
নতুন ঢাকাও গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে৷ এর জন্যেও দায়ী ভিআইপিরা৷ তারাই পরিকল্পনাহীন পরিকল্পনায় ‘উন্নয়ন' নাম দিয়ে ফ্লাইওভার নির্মাণ করছেন৷ তাতে এক জায়গার জট আরেক জায়গায় হস্তান্তর হচ্ছে৷
এখন কিছু নিয়ম নীতির মধ্যে যদি আসা সম্ভব হয়, তবে জনদুর্ভোগ হয়ত কিছুটা কমতে পারে৷ প্রথমে দরকার সুস্পষ্ট নীতি, প্রয়োজনে আইন করে নির্ধারণ করতে হবে ভিআইপি কারা? প্রথমে ভিআইপি মর্যাদা দিতে হবে অ্যাম্বুলেন্সকে৷ যে-কোনো গাড়ি আটকে অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের ব্যবস্থা করে দিতে হবে৷
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ ভিআইপি মর্যাদা পাবেন কিনা, নির্মোহভাবে তা নির্ধারণ করতে হবে৷
মন্ত্রীরা পুলিশ প্রহরা পেতে পারেন৷ অন্য গাড়ি দাঁড় করিয়ে বা উলটো দিক দিয়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে৷ এখনো যে সিদ্ধ আছে, তা নয়৷ এভাবে গাড়ি যাতে যেতে না পারে, ঘোষণা দিয়ে পুলিশকে সেই ক্ষমতা দিতে হবে৷ সাধারণ মানুষ যেভাবে জ্যামে আটকে থাকে, মন্ত্রী-সচিবরাও সেভাবে আটকে থাকবেন৷ লালবাতি, সবুজবাতির রসিকতা বন্ধ করতে হবে৷ পুরো শহর মনিটরিংয়ের জন্যে মন্ত্রী রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবেন না, সিসিটিভি ক্যামেরার উপর নির্ভর করতে হবে, যা অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি৷ এত কম খরচে এর চেয়ে বেশি সুবিধা আর কোনো কিছুতে পাওয়া যাবে না৷ ভালো মানের ক্যামেরা এবং তা যদি সচল থাকে, নগরের অপরাধ প্রবণতাও কমে যেতে পারে৷
তথাকথিত এসব ভিআইপিরা যদি নিয়ম মেনে চলেন, তাদের যদি নিয়ম মানতে বাধ্য করা যায়, তবে জনদুর্ভোগ কিছুটা হয়ত কমতে পারে৷ এতে জনদুর্ভোগ যতটা না কমবে, মানুষের মনের ক্ষোভ তার চেয়ে অনেক বেশি কমতে পারে৷
তথাকথিত যে ভিআইপিদের কথা লেখক লিখেছেন, তাঁরা কি কখনো নিয়ম মানতে বাধ্য হবেন? লিখুন নীচের ঘরে৷