জনগণের টাকায় ডাক্তার নয়?
১৫ মে ২০১৪আমার ব্লগে রাজীব দে সরকার লিখেছেন এ বিষয়ে৷ লেখার শিরোনাম, ‘‘জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হওয়া মানুষগুলোর কথা''৷
‘‘ডাক্তার হচ্ছে জনগণের ট্যাক্স-এর টাকায়'' – এ ধারণার বিপক্ষে তিনি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘ভাবটা এমন যেন সরকারি মেডিকেল কলেজে যারা পড়ছন কেবল তারাই জনগণের টাকায় পড়ছে৷ তাই জনগণের টাকার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব কেবলমাত্র ডাক্তারদের৷''
এটা হয়ত ঠিক যে ‘জনগণের টাকা' সব বিষয়ের লেখাপড়াতে ব্যয় হলেও হাতে গোনা কয়েকটি পেশার দিকেই সমাজ বেশি আঙুল তোলে৷ যাঁর দায়িত্ব যত বেশি বা যত বড়, তাঁর কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকা কি খুব অসমীচীন? যাঁদের কাজ জীবন বাঁচানো, তাঁদের সঙ্গে কি সবার তুলনা চলে?
এ সব ভাবনার প্রতিফলন নেই রাজীব দে সরকারের লেখায়৷ বরং ‘সরকারি' এবং ‘বেসরকারি' মেডিকেল কলেজের পার্থক্য মনে করিয়ে দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘এমনকি যারা কষ্ট করে টাকা খরচ করে বেসরকারি মেডিকেলে পড়ছে, তাদেরও শুনতে হয় এই ট্যাক্স-এর টাকার কথা৷ তারা বলে, ডাক্তার তৈরির জন্য জনগণের ট্যাক্সের অনেকটাই ব্যয় হচ্ছে৷ এই কথাগুলো ঠিক না৷''
বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে রাজীব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারি অধ্যাপকের বক্তব্য তুলে ধরেছেন৷ সেই চিকিৎসক বলেছেন, ‘‘ডাক্তার তৈরিতে জনগণ যে টাকা লগ্নি করছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিদান জনগণ সরাসরি মেডিকেল কলেজগুলো থেকে পাচ্ছে৷ ধরুন, সরকার প্রতি বৎসর ঢাকা মেডিকেলের ব্যয় বাবদ ১০০ কোটি টাকা দিচ্ছে৷ ....এই টাকার ৮০-৯০ শতাংশ জনগণের জন্যই খরচ হচ্ছে৷'' কাগুজে হিসেব আর বাস্তবতার অমিল যে কত বেশি তা সব ক্ষেত্রে ভুলে গেলে কি চলে? বাংলায় একটি প্রবচন আছে না, ‘‘কাজির গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নেই?'' বরাদ্দের কত ভাগ, কিভাবে জনগণ পাচ্ছে, শহর আর গ্রামাঞ্চলে কাছাকাছি হারেও পাচ্ছে কিনা, সেবা আর বরাদ্দ এক কথা কিনা – এসব প্রশ্নও তো অগ্রাহ্য করার মতো নয়৷
আমার ব্লগের এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যেসব জনগণ ওখানে চিকিৎসা পায় তার ঔষধ, খাবার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, হাসপাতালের যাবতীয় খরচ (বেড শিট, মশারি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি ইত্যাদি), হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন সব কিন্তু জনগণের জন্যই৷ ছাত্রদের পেছনে খুব সামান্যই ব্যয় হয়৷ বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা তো জনগণই খরচ করে৷''
তারপর মেডিকেল কলেজগুলো থেকে জনগণ যে সেবা পাচ্ছে তার বাজার মূল্যও নিরূপন করেছেন রাজীব৷ তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, ‘‘ঢাকা মেডিকেলের কথাই ধরুন, এখানে প্রতিদিন গড়ে ১০০টি অপারেশন হয়৷ প্রতিটি অপারেশন যদি গড়ে ৩০,০০০ টাকা করে ধরেন, তাহলে প্রতিদিন ৩০ লাখ টাকার অপারেশন হচ্ছে৷ সেই হিসেবে বছরে আসে ১০৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা৷ এক অপারেশন সেবা দিয়েই মেডিকেল কলেজগুলো জনগণের প্রদত্ত ট্যাক্সের টাকার পুরোটাই ফেরত দিয়ে দিচ্ছে৷ বহির্বিভাগে রোগী দেখা, জরুরি বিভাগে রোগী দেখা, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেয়া, ভর্তি, রোগী দেখা – এ সবের চার্জ হিসেব করলে সেটা যে কত দাঁড়াবে তা আল্লাহই জানেন৷''
রাজীব দে সরকার মনে করেন, ‘‘বাস্তবে সরকার/জনগণ মাত্র কয়েক কোটি টাকা এইসব মেডিকেল কলেজে খরচ করে আর বিনিময়ে শত শত কোটি টাকার সেবা পায়৷ তাহলে বুঝলেন কি ‘জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হচ্ছ' কথাটা মোটেও ঠিক না৷ বরং জনগণকে কোটি কোটি টাকার সেবা দানের মাধ্যমে এক এক জন ডাক্তার তৈরি হচ্ছে৷''
এ পর্যায়ে ডাক্তারি ছাড়া অন্যান্য বিভাগেও যে প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী সরকারি খরচে পড়ছে সেই তথ্যও পরিবেশন করেছেন রাজীব৷ তথ্যগুলো মনগড়া নয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যই পরিবেশন করেছেন তিনি৷
রাজীব শেষ করেছেন, বিএমএর মহাসচিব ইকবাল আরসালানের বক্তব্য দিয়ে৷ তাঁকে উদ্ধৃত করে রাজীব লিখেছেন, ‘‘চিকিৎসকরা তৈরি হয় বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে৷ দেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র তার নাগরিকের চিকিৎসা সেবা দিতে বাধ্য৷ সে কারণেই দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য গড়ে ওঠে বড় বড় সরকারি হাসপাতালগুলো৷ সেখানে সরকারি নিয়োগপ্রাপ্ত কনসাল্টেন্টসহ অন্যান্য সরকারি ডাক্তাররা মূলত মানুষের চিকিৎসা দেন৷ এই প্রক্রিয়া চলাকালীন মেধাবী কিছু ছেলে-মেয়ে হাতে কলমে শিখে-পড়ে চিকিৎসক হয়ে বের হচ্ছে৷ এখানে তাঁকে চিকিৎসক বানানোর পেছনে কোনো আলাদা খরচ করা হচ্ছে না৷ খরচ সরকার করছে, মানুষের চিকিৎসার পেছনে, কাজেই সে আপনাদের টাকায় পড়ে চিকিৎসক হয়নি, এটা সেই ছেলে-মেয়েটির ক্রেডিট; দুর্বলতা নয়....৷''
সংকলন: আশীষ চক্রবর্ত্তী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ