‘জঙ্গিবাদ বেহেস্তের পথ নয়'
১৩ জুলাই ২০১৬ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে জঙ্গিদের কৌশলকে এভাবেই ব্যাখা করলেন প্রখ্যাত আলেম ও শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ৷ বললেন, জনপ্রতিরোধের শক্তি হ্রাস করতে পারলে জঙ্গিদের কাজ করা সহজ হবে৷ তাই ‘‘তারা এই কৌশল নিয়ে বড় বড় জায়গায় হামলা চালাচ্ছে৷ অভাবিত জায়গায় হামলা চালাচ্ছে তারা৷''
জঙ্গিদের আসল ‘টার্গেট' হয়ত ছিলেন এই মাওলানা – শোলাকিয়া ঈদগাহের পাশে জঙ্গি হামলার তদন্তকারীরা বলছেন এমনটাই৷ কারণ কয়েকদিন আগে তিনিই লাখো আলেমের স্বাক্ষর নিয়ে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছিলেন, যা অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি৷
ডয়চে ভেলে: ধর্মের নামে যারা মানুষ হত্যা করছে, তাদের কীভাবে দেখা হয়, হচ্ছে?
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ: মানুষ হত্যা অপরাধ৷ আর ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করা জঘন্যতম অপরাধ৷ ইসলামে বলা হয়েছে, কোনো কারণ ব্যতীত, কারণ বলতে যদি সেই ব্যক্তি কাউকে হত্যা করে থাকে – এমন কারণ ব্যতীত যদি কাউকে হত্যা করা হয়, তাহলে গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করা হয়৷ অন্যদিকে কারো যদি প্রাণ রক্ষা করা হয়, তাহলে তার মাধ্যমে গোটা মানবজাতিরই প্রাণ রক্ষা করা হয়৷
ধর্ম প্রচারে কাউকে হত্যা কি আদৌ করা যায়?
এটা একেবারেই জায়েজ নয়৷ ইসলামে কঠোরভাবে এটি নিষেধ করা হয়েছে৷ দীনের ব্যাপারে কোনোরকম জবরদস্তি হতে পারবে না৷ বলা হয়েছে, ‘তোমরা ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি করো না৷' কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের আমি দুনিয়াতে দারোগা বানিয়ে পাঠাইনি যে, তোমরা ধর্মের নামে জবরদস্তি করবে৷ তোমরা মানুষকে হেকমতের সঙ্গে, সুন্দর বচনের সঙ্গে এবং সুন্দর বিতর্কের সঙ্গে দাওয়াত দাও৷' এটা কোরআন শরিফের নির্দেশ, এটা আয়াতে আছে৷
নবীজীর আমলে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যে যুদ্ধ হয়েছিল এবং এখন ধর্মের নামে যে হত্যা হচ্ছে – এ দু'টোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
রসুল করিম (সা.) কখনও ধর্মান্ধকরণের জন্য যুদ্ধ করেননি৷ সেই যুদ্ধগুলো তো রসুলের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল৷ রসুল করিম (সা.) মদিনা পর্যন্ত এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ সেখানেও তারা তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না৷ আক্রমণের পর আক্রমণ করেছে৷ দেখুন, বদরের ময়দান কি মদিনার কাছাকাছি না মক্কার কাছাকাছি? খন্দকের যুদ্ধে তো তারা মদিনায় এসে আক্রমণ করল৷ তা আপনার ঘরে আক্রমণ করলে আপনি তাদের প্রতিহত করবেন না? একটাও যুদ্ধ সেখানে হয়নি ধর্ম প্রচারের জন্য বা ধর্মান্ধকরণের জন্য৷ ইসলামে একটা জিনিস আছে ‘জিহাদ'৷ জিহাদ বলতে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করার জন্য কাজ করা৷ জিহাদ আর সন্ত্রাস এক জিনিস না৷ সন্ত্রাস কোরআনের পরিভাষায় দু'টি শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে – একটা ফিতনা আর একটা ফাতাহ৷ সন্ত্রাস হত্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর৷ তাই রসুল করিম (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না৷ আল্লাহ সন্ত্রাসীদের পছন্দ করেন না৷'
যারা এ ধরনের সন্ত্রাস করছে তারাও তো মুসলমান৷ শোলাকিয়ার মতো জায়গায়তেও তারা হামলা করতে চলে গেল৷ ধর্মে এদের ব্যাপারে ব্যাখা কী রকম?
আপনি বলুন, একজন মুসলমান কি মসজিদে হামলা করতে পারে? এতেই তো বোঝা যায়, যে ছেলেগুলোকে মাঠে নামিয়েছে, যে তাদের এতটাই বিভ্রান্ত করেছে যে তারা ন্যায়-অন্যায়কে ভুলে গেছে, যারা এদের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে, তারা নিঃসন্দেহে ইসলাম এবং মুসলমানের শত্রু৷ এরা হলো বিভ্রান্ত৷ আমরা এক লাখ আলেমের যে ফতোয়াটা বের করেছি, সেখানে কোরআন-হাসিদের রেফারেন্স নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমরা৷ আলোচনা করেছি – এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় কিনা, এটাকে জিহাদ বলা যায় কিনা, আত্মঘাতী হামলা ইসলামের দৃষ্টিতে কী ধরনের অপরাধ, কোনো নিরিহ বান্দাকে হত্যা করা, মুসলিম সমাজে বসবাস করা কোনো অমুসলিমকে হত্যা করা কোন ধরনের অপরাধ৷ রসুল তো বলেছেন, এরা বেহেস্ত তো দূরের কথা, বেহেস্তের গন্ধও পাবে না৷
এই যে পরপর দু'টি হামলা হয়ে গেল...এখন আমাদের আলেম সমাজের এই হামলা বন্ধে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
আমি তো মনে করি, এখন সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব আলেমদের৷ কেন? কারণ যেহেতু তাঁরা ধর্মের নামে কাজ করছে, বেহেস্ত পাওয়ার আশায় কাজ করছে৷ তাই এখন আলেমদেরই বিষয়টি স্পষ্ট করা মানুষকে বোঝানো উচিত৷ তাছাড়া এ কাজটা আলেমরাই করতে পারেন৷ কারণ অন্যরা করলে তো সাধারণ মানুষ তা গ্রহণ করবে না৷ তাই ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যাঁরা, তাঁদেরকেই ইসলাম সম্পর্কে ধারণাটা স্পষ্ট করে তুলে ধরতে হবে৷ ইসলামে জঙ্গিবাদের পথকে ধর্মের পথ বলা হয়নি, বেহেস্তের পথ বলা হয়নি৷ এটা জাহান্নামের পথ৷ তাই আলেমদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি৷ এখন আলেমদের উচিত এবং অন্যতম প্রধান কর্তৃব্য হলো তরুণদের যে মনোবৈকল্য ঘটছে, বিভ্রম ঘটছে, এই বিভ্রান্তি থেকে তাদের উদ্ধার করা৷
আপনি যখন এক লাখ আলেমের স্বাক্ষর নিয়ে মিডিয়ার কাছে দিলেন, তখন একটা গ্রুপ এর বিরোধিতাও করেছে৷ এই সব হামলার সঙ্গে তাদের কোনো যোগসূত্র বা অন্য কোনো সংশ্লিষ্টতা আপনি কি দেখছেন?
তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আমি জানি না৷ তবে তাদের কথায় সন্ত্রাসীরা যে উৎসাহিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ ওরা কিন্তু ফতোয়ার সত্যতাকে অস্বীকার করতে পারেনি৷ ওরা বলছে, ফতোয়া দেয়ার জন্য মুফতি হতে হবে৷ এই কথাটা ওরা জানে না বলেই বলছে৷ কারণ ইসলাম সম্পর্কে যার জানাশোনা আছে, যিনি বিশেষজ্ঞ, একমাত্র তিনিই এটা দিতে পারেন৷ এ কথা সর্বজন স্বীকৃত৷ আমাদের সুপ্রিম কোর্টে ফতোয়া সম্পর্কে যে রায় আছে, সেখানে এটা উল্লেখ আছে৷ মুফতি হওয়া কোনো শর্ত নয়৷
জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সরকারের কী ভূমিকা রাখা উচিত?
সরকারকে এ ব্যাপারে আরো ক্ষিপ্র এবং কৌশলী হতে হবে৷ তাদের দেশের সমস্ত জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে জনপ্রতিরোধের কাজে লাগাতে হবে৷ কারণ জনপ্রতিরোধ ছাড়া একা সরকারের পক্ষে এটা দমন করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না৷ সন্ত্রাসীরা যে কৌশল নিয়েছে, এটা জেনেই নিয়েছে যে, একটা-দু'টা হামলা চালিয়ে সরকার পরিবর্তন হবে না৷ এমনকি সমাজ পরিবর্তনও হবে না৷ তাই তাদের সমর কৌশল হলো – সমাজের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া৷ কারণ এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, মানুষের মধ্যে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, তখন তাদের প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়৷ আতঙ্কিত মানুষের প্রতিরোধ শক্তি হ্রাস পায়৷ জঙ্গিরা মনে করেছে, তারা যদি জনপ্রতিরোধ শক্তি হ্রাস করতে পারে তাহলে তাদের জন্য কাজ করা সহজ হবে৷ তাই তারা এই কৌশল নিয়ে বড় বড় জায়গায় হামলা চালাচ্ছে, অভাবিত জায়গায় হামলা চালাচ্ছে তারা৷
এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে, মুসলিম উম্মাহর উদ্দেশ্যে আপনার আহ্বান কী হবে?
আমার আহ্বান হবে দু'টো৷ প্রথমত, দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আমার আহ্বান হবে – তাঁরা যেন আতঙ্কিত না হয়ে, ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন৷ কোরআন-হাদিসের নির্দেশও তাই৷ আর দ্বিতীয়ত, বিভ্রান্ত এই তরুণদের আমি আহ্বান জানাবো – হে তরুণ, তুমি বেহেস্ত পাওয়ার আশায় যে পথে অগ্রসর হচ্ছো, সেই পথ বেহেস্তের পথ নয়৷ সে পথ জাহান্নামের৷ তাই তুমি তাড়াতাড়ি শান্তির পথে, ইসলামের পথে, ইসলামের মৌল চেতনার পথে ফিরে এসো৷ আমরা অভিভাবকরা অবিবেচক নই, তোমার জন্য আমদের হৃদয় আজও উন্মুক্ত, এখনও খোলা৷
যেসব পরিবার থেকে এ সব তরুণরা জঙ্গিবাদের দিকে যাচ্ছে, সেই সব পরিবারের প্রতি আপনার আহ্বান কী?
এই তরুণদের বিভ্রান্তির পেছনে সবচেয়ে বড় যে কারণ কাজ করছে, তা হলো পারিবারিক ব্যর্থতা এবং আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা৷ পারিবারিক ব্যর্থতা হলো – আমরা জবরদস্থি করে একটা তিন বছরের বা সাড়ে তিন বছরের ছেলের ঘাড়ে বইয়ের বোঝা দিয়ে আতাদের ইংরেজিতে হাসতে শেখাচ্ছি, কাঁদতে শেখাচ্ছি, ইংরেজিতে টয়লেটে যেতে শেখাচ্ছি৷ ফলে সে একটা শিকড় বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে উঠছে৷ এক্ষেত্রে সমাজপতিদের হুঁশ হওয়া দরকার৷ সাধারণ মানুষেরও ভাবা দরকার যে, সমাজকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি? সন্তানদের কোথায় ঠেলে দিচ্ছি অসহায়ভাবে? আমার এই আহেবানই থাকবে যে, সন্তানই সব৷ তাই তাই সন্তানের দিকে ফিরে এসো, সন্তানকে আদর করতে শেখো৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷