ছিনতাইকারী আর ডাকাতদের বিরুদ্ধে পথে নামলেন ঢাকাবাসী
২৭ অক্টোবর ২০২৪ঢাকার মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় দিনে-দুপুরে ডাকাতি, ছিনতাই যেন স্বাভাবিক ঘটনা৷ কয়েকদিন আগে একটি দোকানে ঢুকে চাপাতির মুখে ডাকাতি করে দৃর্বত্তরা৷ ওই এলাকার নবোদয় হাউজিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার সময় এক ছাত্রীকে কয়েকজন ছিনতাইকারী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে৷ পরে তার ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়৷ ঘটছে গণছিনতাইয়ের মতো ঘটনাও৷
ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে শনিবার সকালে মোহাম্মদপুর এলকায় বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা৷ বিক্ষোভ থেকে ৭২ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেন তারা৷ এরপরই সক্রিয় হয় সেনাসদস্য ও পুলিশ৷
শনিবার গভীর রাতে তারা অভিযান চালিয়ে ডাকাত দলের মূলহোতাসহ ৪৫ জনকে আটক করেছে৷ তাদের কাছ থেকে ১৮টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২৬২ রাউন্ড গুলি, ১৯ ধরনের মাদক দ্রব্য ও গ্রেনেড জব্দ করা হয়েছে৷
এই পরিস্থিতিতে মোহাম্মদপুরের প্রতিটি হাউজিংয়ে সেনা ক্যাম্প বসানোর কথা জানিয়েছেন ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া মেজর নাজিম আহমেদ৷
প্রতিবাদে অংশ নেয়া মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা পারভেজ হাসান সুমন জানান, ‘‘মোহাম্মদপুরের বসিলা, চাঁদ উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, নবোদয় হাউজিং থেকে শুরু করে পুরো বেড়িবাধ এলাকা অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে৷ এখানে নানা অপরাধী গ্রুপ আর কিশোর গ্যাং সক্রিয়৷ ৫ আগস্টের পর পুলিশও অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে যায় ফলে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বেড়ে গেছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘গত পরশু (শুক্রবার) রাতে কিশোর গ্যাংয়ের ৩০-৪০ জন সদস্য গণ ছিনতাই করেছে রাস্তায়৷ একটি দোকানে ঢুকে অস্ত্রের মুখে ডাকাতি করেছে৷ দিনের বেলায় একজন ছাত্রীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনতাই করেছে৷ এগুলোর ভিডিও ভাইরাল হলেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷ ফলে আমরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছি৷''
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘আমরা কয়েকজন ছিনতাইকারীকে ধরে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেয়ার পর আবার আরেক গ্রুপ ছিনতাইকারী পাশেই ছিনতাই করে৷''
গণছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন শিক্ষার্থী দিপু আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘ওই ঘটনা আমার কাছে বিভীষিকার মতো৷ মনে হচ্ছিল, ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধের কেউ নেই৷ আমি প্রাণ ভয়ে আমরা মেবাইল ফোন এবং পকেটে কিছু টাকা ছিলো তা ছিনতাইকারীদের দিয়ে দিই৷''
ছিনতাইকারীদের সবার হাতে চাপাতি, ছুরিসহ ধারালো অস্ত্র ছিল বলেও জানান এই শিক্ষার্থী৷ বলেন, ‘‘মানুষ ভয়ে ছুটে পালাচ্ছিলেন৷''
মোহাম্মদপুরে ১১ অক্টোবর গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাতদল এক ব্যবসায়ীর বাসায় ঢুকে সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে৷ এ ঘটনা সবার মনে আতঙ্ক তৈরি করেছে৷ ২০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরেই দিনে-দুপুরে অস্ত্রের মুখে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে৷ সকাল সোয়া ১০টার দিকে মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড ৩ নম্বর সড়কে নেসলে কোম্পানির পণ্য পরিবহনকারী একটি গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা৷ গত ১০ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেয়ায় রবিউল ইসলাম নামে এক নিরাপত্তাকর্মীর বুকে, পিঠে ও হাতে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা৷
শুধু মোহাম্মদপুরে নয়, বলতে গেলে পুরো ঢাকার চিত্র এমন৷ ১৮ অক্টোবর রাত ২টার দিকে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বাসায় ফেরার পথে মগবাজার রেলক্রসিংয়ের কাছে ডাকাতির শিকার হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিবলু হক৷ তিনটি মোটরসাইকেলে থাকা সাত দুর্বৃত্ত তার গলায় চাপাতি ধরে আইফোন, টাকা, দরকারি কাগজপত্র ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে যায়৷
এ ঘটনায় তিনি মামলা করতে চাইলেও হাতিরঝিল থানা ডাকাতির মামলা নিতে চায়নি৷ শিবলু অভিযোগ করেন, ঘটনার বর্ণনা দিতে হাতিরঝিল থানায় তিন দফা যেতে হয়েছে৷ ডাকাতির মামলা করতে চাইলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা তাদের পরামর্শ মতো লিখতে বলেন৷ পরে মামলা নিলেও ডাকাতির বর্ণনা দিতে রাজি হয়নি পুলিশ৷
তিনি বলেন, ‘‘আমি এখনো ট্রমার মধ্যে আছি৷ ছিনতাইয়ের সময় রাস্তায় পুলিশের কোনো টহল ছিল না৷ তবে অনেক গাড়ি ছিলো৷ তারা ভয়ে সহায়তা করতে এগিয়ে আসেনি৷ ছিনতাইকারীরা যখন আমার গলায় চাপাতি ধরে, তখন আমি এত ভয় পেয়েছি যে এখনো সেই ভয় কাটেনি৷ আমার ফোন, টাকা ও কাগজপত্র পুলিশ এখন উদ্ধার করতে পারেনি৷''
ঢাকায় এই বছরের শুরু থেকে গত ৯ মাসে চুরি কমলেও বেড়েছে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা৷ রাজধানীতে প্রতিদিনই ডাকাতি ও চুরির ঘটনা ঘটছে৷ সবচেয়ে নাজুক অবস্থা মোহাম্মদপুর, উত্তরা ও ডেমরা এলাকায়৷ এসব এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে৷ ঢাকা মেট্রেপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ২৪টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে৷ এগুলোর মধ্যে পুলিশ সদস্যের বাসায়ও ডাকাতি ও চুরির ঘটনা আছে৷ অন্যদিকে, চুরির ঘটনা প্রায় ৫০০টি৷ আর ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়লেও গত দুই মাসে ঢাকায় পুলিশ মামলা নিয়েছে মাত্র ৩৯টি৷
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশ অধিকাংশ ঘটনায়ই ছিনতাইয়ের মামলা নেয় না৷ তারা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বাধ্য করেন৷
ডিএমপির তৈরি করা এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ছিনতাইকারী বেশি সক্রিয় রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, ভাটারা, বাড্ডা, শেরেবাংলানগর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, হাতিরঝিল, মিরপুর, পল্লবী, বিমানবন্দর, খিলক্ষেত ও উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায়৷
ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা প্রতিটি এলাকায় টহল জোরদার করেছি৷ যেসব এলাকায় ঘটনা বেড়েছে, সেসব এলাকায় ইউনিফর্মধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও পুলিশ ডিউটি করছে৷ আর কিছু এলাকা যেমন মোহাম্মদপুর, সেখানে ভৌগোলিক কারণেও অপরাধ প্রবণতা বেশি৷ তাই আমাদের বিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে৷ তবে আমরা এরইমধ্যে কয়েকটি গ্যাংয়ের সদস্যদের আটক করেছি৷ আরো অপরাধীদের চিহ্নিত করেছি৷''
পুলিশ এখন সক্রিয় আছে জানিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘পুরো মনোবল নিয়ে কাজ করছেন সবাই৷''
মামলা না নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে আমরা অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব৷ ওসিরা মামলা না নিলে ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট জোনের ডিসিদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন৷''