আগুনে পোড়া ২০ হাজার টাকার জীবন
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র অবশ্য বলেছেন, ক্ষতিপূরণের জন্য তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে৷ বৃহস্পতিবার এই ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে৷
কিন্তু অবৈধ কেমিক্যাল কারখানার জন্য দায়ীরা সবাই এখনো আইনের আওতায় আসেনি৷ সরেনি কেমিক্যাল গোডাউন ও প্লাস্টিক কারখানা৷ আগুনের সূত্রপাত যে ভবন থেকে, সেই ওয়াহেদ ম্যানশনে এখনো আগুনের ভয়াবহতার চিহ্ন থাকলেও বাকি ভবনগুলো মেরামত করা হয়েছে৷ জীবনযাত্রা ও ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে এসেছে স্বাভাবিক৷ কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় আবারো একইভাবে আগুন আশঙ্কা রয়েছে৷
এই ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তে নেই কোনো অগ্রগতি৷ এক বছরে দেয়া হয়নি ময়না তদন্ত প্রতিবেদন৷ এ পর্যন্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার তারিখ ৯ বার পিছিয়েছে৷ ২৬ ফেব্রুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে৷
গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত৷ ওই আগুনে চারতলা ওয়াহেদ ম্যানশনসহ ৫টি ভবন পুরোপুরি ভস্মিভূত হয়৷ আর আগুনে ৭১ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন অনেকে৷
আগুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বলা হয়েছে, ‘‘ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের দুই ছেলে মো. হাসান ও সোহেল ওরফে শহীদ তাদের চারতলা বাড়ির বিভিন্ন ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ রাখতেন৷ মানুষের জীবনের ঝুঁকি জেনেও অবৈধভাবে রাসায়নিকের গুদাম করার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বাসা ভাড়া দেন৷ আর ওই দাহ্য পদার্থ থেকেই আগুন লাগে৷'' যদিও প্রথমে প্রচারের চেষ্টা করা হয়েছিলো যে, রাস্তায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন লাগে৷ বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বিষ্ফোরণের কাহিনীও ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল৷
মামলার এজাহারভুক্ত আসামি দুই ভাই হাসান ও সোহেল গ্রেপ্তার হলেও পরে উচ্চ আদালত থেকে তারা জামিন পান৷ পুলিশ বলছে, গোডাউনের অন্য মালিকদের ঠিকানা নিশ্চিত হতে না পারায় তাদের এখনো আইনের আওতায় আনা যায়নি৷
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার মোহাম্মদ সিদ্দিক উল্লাহ ( ৪৫) চুড়িহাট্টা এলাকার একটি প্লাস্টিক কারখানার গোডাউনে কাজ করতেন৷ ওই দিন আগুনে তিনি নিহত হন৷ তার বড় ছেলে আহসান উল্লাহ এখন চকবাজারে একটি প্লাস্টিকের দোকানে কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘বাবার লাশ আনার সময় মর্গে আমাদের ২০ হাজার টাকা দেয়া হয়৷ পরে প্লাস্টিক কারখানার মালিক সমিতি ৫০ হাজার টাকা দেয়৷ আর আমাদের নোয়াখালীর এমপি দেন এক লাখ টাকা৷ এর বাইরে আমরা কোনো সহায়তা পাইনি৷’’
তারা পাঁচ ভাই-বোন৷ আহসান উল্লাহ সবার বড়৷ তিনি এখন যে চাকরি করেন, তাতে বেতন মাত্র ছয় হাজার টাকা৷ ছোট ভাই-বোনদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে৷
আগুনের পর ওই এলাকায় অবৈধ প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদের উদ্যোগ নেয় সিটি কর্পোরেশন৷ তবে তা সফল হয়নি৷ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় মালিকরা৷ ওয়াহেদ ম্যানশন ছাড়া আর সব ভবনেই আবার কেমিক্যাল গোডাউন এবং প্লাস্টিক কারখানা চালু হয়েছে বলে জানান আহসান উল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘‘আজও (১৯ ফেব্রুয়ারি) আমি চুড়িহাট্টায় গিয়েছিলাম৷ নিহতদের পরিবারের আরো অনেক সদস্য গিয়েছিলেন৷ তাদের অবস্থাও একই রকম৷ অধিকাংশ পরিবারই হাসপাতাল মর্গের ওই ২০ হাজার টাকাই পেয়েছে৷ আর কিছু পায়নি৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘ওখানে আগের মতোই দোকান-পাট, ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে৷ কেমিক্যাল গোডাউন, প্লাস্টিক কারখানা আবারো চালু হয়েছে৷ তবে কিছুটা গোপনে৷’’
আগুনে নিহত জুম্মন মিয়ার ছেলে আসিফ হোসেন এখন চকবাজারেই একটি টেইলরিং শপে চাকরি করেন৷ তিনি এই ঘটনায় মামলারও বাদী৷ আসিফ হোসেন বলেন, ‘‘আমরাও ২০ হাজার টাকা পেয়েছি৷ আর কোনো সহায়তা পাইনি৷ অপরাধীরা আইনের আওতায় আসেনি৷ আমাদের দাবি, যারা এই আগুনের জন্য দায়ী তারা বিচারের আওতায় আসুক৷’’
চুড়িহাট্টা এলাকাটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায়৷ দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আগুনের পর ওই এলাকার প্লাস্টিক কারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউন নতুন জায়গায় সরিয়ে নেয়ার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়৷ তাদের জন্য কেরানীগঞ্জে আলাদা পল্লী হবে৷ কিন্তু সেজন্য শিল্পমন্ত্রণালয় কাজ করছে৷ আর এখন নতুন করে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ওই এলাকার ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমকে উন্নত করা হয়েছে৷ খুব দ্রুত যাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ আর স্থানীয়ভাবে ১৫-২০ মিনিট যাতে ফায়ারের বিরুদ্ধে ফাইট করা যায়, তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷’’
নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটি তালিকা করেছি৷ সেই তালিকা ধরে আগামীকাল (২০ ফেব্রুয়ারি) আগুনের বছর পূর্তিতে ক্ষতিপুরণ দেবো৷ কাউকে চাকরি, কাউকে নগদ টাকা এবং কাউকে দোকান করার সহায়তা দেবো৷ ক্ষতি বুঝে আমরা ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করছি৷’’