চাষে অনাগ্রহী সিঙ্গুর
১৬ জুলাই ২০১৯বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জির রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে পৌঁছনোর যে রাজনৈতিক উত্থান, তার শেষ ধাপ ছিল সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের আন্দোলন৷ শুরুটা হয়েছিল হুগলি জেলার সিঙ্গুরে৷ টাটা শিল্পগোষ্ঠী তাদের ছোট গাড়ি ‘ন্যানো'তৈরির কারখানা করবে বলে যে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, তা মুক্ত করার দাবিতে৷ সিঙ্গুরে তৈরি হয়েছিল কৃষিজমি, জীবন ও জীবিকা বাঁচাও কমিটি৷ মমতা ব্যানার্জি পণ করেছিলেন, কিছুতেই দো–ফসলি, তিন–ফসলি কৃষিজমি কারখানার জন্যে নিতে দেবেন না৷
কিন্তু প্রায় এক দশক পর, সিঙ্গুরের অধিগৃহিত জমির এক বড় অংশ কৃষকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও চাষ হচ্ছে না সিঙ্গুরে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেই রাজ্য বিধানসভায় সম্প্রতি জানিয়েছেন, সিঙ্গুরে মোট ৯৯৭ একর জমির মধ্যে ৯৫৫.৯০ একর জমি ফেরত দেওয়া হয়েছে৷ তার ৬৪১ একর জমিতে চাষ শুরু হয়েছিল৷ কিন্তু পরের বছরই কমে যায় চাষের পরিমাণ৷ ২০১৮–১৯ সালে সিঙ্গুরে ৭৯২ জন কৃষক চাষ করেছেন মাত্র ২৬০ একর জমিতে৷ অনেকেই চাষ করা ছেড়ে দিয়েছেন৷ এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য, তাঁর সরকার জমি ফিরিয়ে দিয়েছে৷ চাষের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ কিন্তু কৃষকরা চাষ করবেন কি না, সেটা তাঁদের ব্যাপার৷ সরকার সেক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে চায় না৷
সিঙ্গুরের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক এবং সিঙ্গুরে কৃষিজমি রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম মুখ রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আরও কিছু বাড়তি তথ্য দিলেন ডয়চে ভেলে–কে৷ তিনি জানাচ্ছেন, টাটাদের কারখানার জন্যে অধিগৃহিত জমির কিছুটা অংশ জলা জমি ছিল৷ আগেও সেখানে চাষ হতো না, এখনও হয় না৷ বাকি জমির একটা অংশে মাটির ভেতরে কারখানার জন্যে তৈরি করা কংক্রিটের ভিত এখনও রয়ে গেছে৷ মাটি খুঁড়ে সেটা বের না করে দিলে ওই জায়গার জমিও চাষ করা যাবে না৷ এবং সেটা কৃষক, বা সমবায়, কিংবা পঞ্চায়েত বা জেলা প্রশাসনের পক্ষে করা সম্ভব নয়৷ একাজে সরকারের সাহায্য লাগবেই৷ পুরো জমি উদ্ধার করতে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে৷
তবে সিঙ্গুরের বিধায়ক আরও একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করলেন৷ জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাসে ১৬ কেজি করে চাল এবং ২০০০ টাকা ভাতা দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিল রাজ্য সরকার৷ অর্থাৎ বছরে প্রায় ৩০ হাজার টাকা৷ এবং সেটাও বিনা পরিশ্রমে৷ কৃষকদের একাংশ তাই মনে করছেন, তাঁদের জমি চাষের অযোগ্য হয়ে থাকলেই আখেরে লাভ বেশি৷ বিশেষত যে ছোট কৃষকের হয়ত ১০ কাঠা জমি, তিনি চাষ করে, ফসল ফলিয়ে কিছুতেই বছরে অত টাকা উপার্জন করতে পারতেন না৷ কাজেই সরকারি ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা চালু রাখা ওই ছোট কৃষকদের কাছে অনেক বেশি লাভজনক৷
এর পাশাপাশি সিঙ্গুরের কৃষক পরিবারের ছেলেদের অন্য পেশায় চলে যাওয়ার প্রবণতাও আছে৷ যা
মনে পড়িয়ে দিচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি মন্তব্য৷ সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা তৈরির সপক্ষে বুদ্ধদেবের অন্যতম জোরাল যুক্তি ছিল— কৃষকের ছেলে আর কৃষক হতে নাও চাইতে পারে৷ তাঁদের সেই উচ্চাশার কথাও সরকারকে ভাবতে হবে৷