1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

চাল চুরির সংবাদ ঠেকাতে মামলা!

২০ এপ্রিল ২০২০

ঠাকুরগাঁওয়ে ১০ টাকার চাল চুরির ঘটনার খবরের কারণে মামলার শিকার হয়েছেন চার সাংবাদিক৷ অন্য এলাকাতেও সাংবাদিকরা চাল চুরির প্রতিবেদন করতে গিয়ে হামলা এবং হুমকির শিকার হচ্ছেন৷

https://p.dw.com/p/3bB5s
ফাইল ছবিছবি: bdnews24.com

ঠাকুরগাঁওয়ে চাল চুরির প্রতিবেদন প্রকাশ করায় মামলা হয়েছে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী ,  জাগোনিউজ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মহিউদ্দিন সরকার, প্রতিবেদক তানভীর হাসান  (শাওন আমিন) এবং রহিম শুভ-র বিরুদ্ধে৷ শনিবার রাতে ডিজিটাল আইনে বালিয়াডাঙ্গি থানায় মামলাটি করেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলাম ভাসানী৷
এজাহারে বলা হয়েছে, ৯ এপ্রিল বালিয়াডাঙ্গি উপজেলায় ১০ টাকা কেজি দরের ৬৮ বস্তা চাল উদ্ধার হয়৷ এর একদিন আগে তানভীর হাসান এবং রহিম শুভ মোমিনুল ইসলাম ভাসানীকে ‘চাল চোর’ বলে ফেসবুকে পোস্ট দেন৷ পরে মোমিনুল ইসলাম ভাসানীর বড় ভাই বড় পালাশবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম আমিনকে জড়িয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়৷ এতে মোমিনুল ইসলাম ভাসানী নিজের ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার অভিযোগে মামলা করেন৷

প্রতিবেদনে ভুল এবং প্রতিক্রিয়া
রহিম শুভর দাবি, ‘‘আসলে মামলা করা হয়েছে আমাদের হয়রানি করার জন্য৷ আমি ফেসবুক পোস্টে পরিস্থিতি তুলে ধরেছি৷ আর তার পরদিনই কিন্তু চাল উদ্ধার হয়েছে৷  এর আগেও আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছে৷’’

হয়রানির জন্য মামলা করা হয়েছে: রহিম শুভ

তবে তানভীর হাসান স্বীকার করেন যে তার প্রতিবেদনে ভুল ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার প্রতিবেদনে একটু ভুল ছিল৷ যার গোডাউন থেকে চাল উদ্ধার করা হয়েছে, তার নামের সাথে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার ভাইয়ের নামের মিল রয়েছে৷ তাই তার ভাই বলে খবরের হেডিং-এ উল্লেখ করা হয়েছিল৷ আমরা কিছুক্ষণ পরেই তা সংশোধন করে দেই৷ কিন্তু তারপরও মামলা করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা৷ পুলিশ খুব দ্রুত মামলা নেয়৷ আসলে এখানে আমরা যারা করোনায় ত্রাণের চাল চুরির বিরুদ্ধে লিখি, তাদের শায়েস্তা করতেই এই মামলা৷ আমরা যাতে আর কোনো প্রতিবেদন করতে না পারি সেজন্যই এই হীন প্রচেষ্টা৷’’

তিনি জানান, ‘‘সাংবাদিকরা এই মামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নামছেন৷ প্রেসক্লাব কর্মসূচি দেবে৷’’

৮২১ বস্তা চাল উদ্ধার
সেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তার মামলার এজাহারে ৬৮ বস্তা চাল উদ্ধারের কথা বললেও বাস্তবে ওইদিন ৮২১ বস্তা চাল উদ্ধার হয়েছে৷ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক নিখিল চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘‘৯ এপ্রিল সকালে স্থানীয় লোকজন পরিবহণের সময় ৬৮ বস্তা চাল আটক করে পুলিশ ও প্রশাসনকে খবর দেয়৷ এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পুলিশসহ আমরা গিয়ে তাদের আটক করি৷ ওখান থেকে আমরা ভটভটি চালককেও আটক করি৷ পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কয়েকটি গুদামে অভিযান চালিয়ে আরো ৭৫৩ বস্তা চাল উদ্ধার করা হয়৷ চালের মিল এবং গোডাউনের মালিক আমিরুল নামে একজন৷ আমিরুল পলাতক আছেন৷ তার ভাই সামিরুল ও ভটভটি চালক পান্না সরকারকে আটক করা হয়েছে৷’’

খাদ্য নিয়ন্ত্রক জানান, ‘‘এর পিছনে আরো অনেকে জড়িত থাকতে পারেন৷ মামলার তদন্ত করছে পুলিশ৷’’ স্থানীয়দের অনেকে মনে করেন, ওই মিল মালিককে সামনে রেখে প্রভাবশালীরা এই কাজ করেছে৷ তারা এখন নিজেদের রক্ষায় উঠেপড়ে লেগেছে৷

হুমকি দিয়ে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা চলছে: নিখিল চন্দ্র বর্মণ

আমি চাল চোর নই’
স্বেচ্ছসেবক লীগ নেতা মোমিনুল ইসলাম ভাসানী বলেন, ‘‘আমি একজন ডিলার, কিন্তু ওই চাল চুরির সাথে আমি বা আমার ভাই জড়িত নন৷ যে ছয় জনকে আসামি করা হয়েছে সেখানেও আমার নাম নেই৷ তারপরও আমার ছবির ওপর ‘চাল চোর’ লিখে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন তারা৷ আমার ভাইকে জড়িয়ে মিথ্যা খবর প্রকাশ করা হয়েছে৷ আমি লিখিত প্রতিবাদ করার পরও তা সংশোধন করা হয়নি৷ এ কারণেই আমি মামলা করেছি৷’’ তিনি দাবি করেন, ‘‘আমি যেহেতু স্বেচ্ছাসেবক লীগ করি, এটা আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন, তাই ওই অসত্য খবর দিয়ে আওয়ামী লীগের সুনামও ক্ষুন্ন করা হয়েছে৷’’ তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘আমরা চাল চোরদের বিরুদ্ধে তৎপর আছি৷’’

‘মনে হচ্ছে আমি যেন রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছি’

বালিয়াডাঙ্গি এলাকারই আরেকজন সাংবাদিক আল মামুন জীবন৷ তিনি দৈনিক অধিকার নামে একটি পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি৷ তার বিরুদ্ধে ১৩ এপ্রিল রাতে জিডিটাল আইনে মামলা করেছে পুলিশ৷ তার অপরাধ তিনি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা্য় লকডাউনের দাবি করেছিলেন৷ একইসঙ্গে করোনা প্রতিরোধে জেলা প্রশাসনের ব্যর্থতার সমালোচনা করেছিলেন৷ ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি৷ ওই মামলার পর মামুনকে গ্রেপ্তারের জন্য খুঁজছে পুলিশ৷ বালিয়াডাঙ্গির বাসায় গিয়ে মামুনকে না পেয়ে পাশেই দুলছড়ি এলাকায় তার শ্বশুর বাড়িতেও অভিযান চালায়৷ সেখানে তার স্ত্রী এবং শিশু সন্তান ছিল৷ মামুন অভিযোগ করেন,‘‘ আমার স্ত্রী ও শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে এখন ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে৷’’ মামুন বলেন, ‘‘এখন আমি নিজের ফোন ব্যবহার করি না৷ ভয়ে আত্মগোপন করে আছি৷ মনে হচ্ছে আমি যেন রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছি৷’’

পুলিশ তৎপর
মামলার এজাহারভুক্ত সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারে পুলিশ বেশ তৎপর৷বালিয়াডাঙ্গি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) আতিকুর রহমান জানান, ‘‘চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে, আমরা তার তদন্ত শুরু করেছি৷ আমরা তৎপর রয়েছি৷ আসামিদের সময়মতো গ্রেপ্তার করবো৷ মামলা যখন হয়েছে গ্রেপ্তার তো করতেই হবে৷ আর সাংবাদিক আল মামুন জীবনকে গ্রেপ্তারে আমরা একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছি৷ তাকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷’’

এদিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে৷

আরো মামলা
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘‘আমরা আরো মামলাার খবর পাচ্ছি৷ আজ (সোমবার) কুষ্টিয়ায় এক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ দিনাজপুর ও সরিষাবাড়িতে প্রশাসন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে৷’’ তিনি এর অবসান চেয়ে বলেন, ‘‘সাংবাদিকরা সরকারের করোনাবিরোধী যুদ্ধে সহায়তা করছেন৷ কিন্তু ত্রাণের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন করলে ডিজিটাল আইনে মামলা হচ্ছে৷ এটা সরকারের জন্য বিব্রতকর হবে৷’’

সাংবাদিকদের কোনো প্রতিবেদন নিয়ে আপত্তি থাকলে তথ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করা যেতে পারে৷ তারা তদন্ত করে কোনো সমস্যা পেলে ব্যবস্থা নিতে পারে৷ কিন্তু সরাসরি মামলা বন্ধ করার দাবি জানান এই সাংবাদিক নেতা৷

প্রশ্নের মুখে সাংবাদিকদের সুরক্ষা

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মনে করেন এই সময়ে সাংবাদিকদের সুরক্ষা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন৷ তিনি বলেন, ‘‘ত্রাণ চুরি একটি জঘন্য অপরাধ৷ সাংবাদিকরা তা তুলে ধরছেন৷ তাদের যদি এই কাজে বাধা দেয়া হয়, প্রতিবেদন করলে মামলা দেয়া হয়, তাহলে তা মেনে নেয়া যায় না৷ মেনে নিলে ত্রাণ চোরদের উদ্দেশ্য সফল হবে৷’’