চামড়া শিল্পে নতুন সম্ভাবনা
১০ মে ২০১৬রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তনি করা হয়েছে৷ আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য৷ তাছাডা় এখন তৈরি পোশাকের পরই বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনে চামড়া শিল্পের অবস্থান৷
বাংলাদেশ থেকে পাকা চামড়ার পাশাপাশি এখন জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, ওয়ালেট বা মানিব্যাগ বিদেশে রপ্তানি হয়৷ এছাড়াও চামড়ার তৈরি নানা ‘ফ্যান্সি' পণ্যেরও চাহিদা রয়েছে৷ বাংলাদেশে প্রচুর হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এ সব পণ্য তৈরি করে বিশ্বের বাজারে পাঠাচ্ছে৷
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তনি হবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা গত বছরের তুলনায় শতকরা ৭ দশমিক ২৮ ভাগ বেশি৷
বাংলাদেশের চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার হলো ইটালি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র এবং ক্যানাডা৷ এর বাইরে জাপান, ভারত, নেপাল ও অস্ট্রেলিয়াতেও বাজার গড়ে উঠছে সাম্প্রতিক সময়ে৷
তবে বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা জাপান৷ মোট রপ্তানি পণ্যের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ তাই যায় জাপানের বাজারেই৷ এর অন্যতম কারণ, বাংলাদেশি চামড়ার জুতার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই জাপান ‘ডিউটি ফ্রি' ও ‘কোটা ফ্রি' সুবিধা দিয়ে আসছে৷
বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বাজার এখন ২১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের৷ বাংলাদেশ বিশ্ব বাজারের শতকরা ০.৫ ভাগ রপ্তানি করে৷ তবে এটা আরো বাড়াতে চায় বাংলাদেশ৷ ২০১৭ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে চায়৷
চীনের চামড়া শিল্প নিয়ে এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১২-১৩ সালে চীনে চামড়ার তৈরি জুতা শিল্পের উৎপাদন ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ কমেছে৷ তাই বিশ্বে চীনের ছেড়ে দেওয়া জুতার বাজারের অংশটি ধরতে চাইছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা৷ এক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সুবিধা সস্তা শ্রম এবং নিজস্ব চামড়া৷ তাছাড়া সরাসরি কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদনও বাড়ছে৷
বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ কোটি ৬৫ লাখ ‘পিস' কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়৷ এর মধ্যে ছাগলের চামড়া ১ কোটি, গরু ৫০ লাখ, ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ পিস৷ অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়৷ আর এই চামড়ার প্রায় অর্ধেকই পাওয়া যায় কোরবানির ঈদের সময়৷
১৯৯০ সাল পর্যন্ত কাঁচা চামড়া বা ‘ওয়েট-ব্লু লেদার' এবং প্রক্রিয়াজাত চামড়া বা ‘ক্রাস্ট লেদার' রপ্তানি করে আসলেও, এখন বেশি রপ্তানি হয় ‘ফিনিশড লেদার'৷ বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন বর্গফুট ফিনিশড লেদার উৎপাদন হয়, যার বেশির ভাগটাই রপ্তানি করা হয়৷ ২০১৪ সালে যেখানে ২৮০ মিলিয়ন বর্গফুট ফিনিশড লেদার উৎপাদিত হয়েছে, সেখানে রপ্তানি হয়েছে ২৬০ মিলিয়ন বর্গফুট৷
ট্যানারি ছাড়াও বাংলাদেশে ১১০টি জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনের শিল্প কারখানা আছে৷ চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার জন্য আছে ২০৭টি শিল্প-কারখানা৷ সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতিবছর ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন জোড়া জুতা তৈরি হয় বাংলাদেশে৷ বলা বাহুল্য, অভ্যন্তরীণ চাহিদার শকতরা ৫০ ভাগই মেটানো হয় দেশের তৈরি জুতা দিয়ে৷
বাংলাদেশের জুতা তৈরি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ‘অ্যাপেক্স'৷ গাজীপুরে অ্যাপেক্স-এর নিজস্ব কারখানায় প্রতিদিন ২০ হাজার জোড়া জুতা তৈরি হয়৷ দেশীয় চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি টিম্বারল্যান্ড, এলডো ও এবিসি মার্টের মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানির জন্যও জুতা তৈরি করে অ্যাপেক্স৷
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন-এর সভাপতি শাহীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমাদের প্রধান সুবিধা হচ্ছে, চামড়া আমরা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই পাই৷ তার ওপর এখানে শ্রমিকের মজুরিও কম৷ ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা তুলনামূলকভাবে কম দামে চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য দিতে পারি৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমরা মান নিশ্চিত করি৷ যারা বাইরের বাজারের ক্রেতা, তাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা পণ্য তৈরি করি৷ তারা যে মানের পণ্য চান আমরা সেই মান নিশ্চিত করি৷ বায়াররা উপস্থিত থেকেই মান পরীক্ষা করেন৷''
শাহীন আহমেদের কথায়, ‘‘আমরা প্রধানত এশিয়া এবং ইউরোপের বাজারেই রপ্তানি করি৷ অ্যামেরিকার বাজার এখনো আমাদের বাইরে রয়েছে৷ তবে ভবিষ্যতে সেখানেও আমরা রপ্তানির চেষ্টা করছি৷''
তবে বাংলাদেশের চামড়া শিল্প নিয়ে বড় অভিযোগ হলো, এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এবং এখানে অবাধ শিশুশ্রম দেখা যায়৷ শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের চর্মশ্রমিকদের অত্যন্ত ঝঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে হয়৷ ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ হাজারিবাগ এলাকাতেই প্রায় ৯০ ভাগ চামড়া শিল্প রয়েছে৷ এখানকার শিল্প-কারখানাগুলো বছরের পর বছর মাটি, পানি, বাতাস বিষাক্ত করছে৷ ঢাকার অদূরে সভারে চামড়া শিল্পের জন্য আলাদা শিল্প এলাকা তৈরি করা হলেও, সেখানে যেতে আগ্রহ নেই অধিকাংশ শিল্প মালিকদের৷
কিন্তু কেন? জবাবে শাহীন আহমেদ জানান, ‘‘আমরা হাজারিবাগ থেকে চামড়া শিল্প সরিয়ে নিতে চাই৷ এ জন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার৷ সরিয়ে নিতে আমাদের ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে৷ তাই আমরা চাই সরকার আমাদের এ জন্য স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা করুক৷ কারণ ব্যাংকের শতকরা ১২ ভাগ সুদ দিয়ে আমাদের পক্ষে ঋণ নেয়া কঠিন৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘চড়া সুদে ঋণ নিয়ে যদি আমরা চামড়া শিল্প স্থানান্তর করি, তাহলে আমাদের এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷''
হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি চড়া সুদে স্থানান্তরিত করলে সত্যিই কি চামড়া শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে? লিখুন নীচের ঘরে৷