চট্টগ্রামে বাড়ছে জলাবদ্ধতা
২৫ জুলাই ২০১৭ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই সমস্যাকে দেখিয়ে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থা পৃথক পৃথকভাবে নানা প্রকল্প নিচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটা উলটো ফল বয়ে আনতে পারে৷ এটা না করে দরকার সমন্বিত একটি উদ্যোগ৷
ভারী বর্ষণ আর জোয়ারে বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বহু এলাকাই এখন কোমর থেকে বুক পরিমাণ পানিতে ডুবে আছে৷ এটাকে স্মরণকালের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা বলে আখ্যায়িত করছেন অনেকে৷
সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত এই নগরীর প্রাকৃতিকভাবে সাগর-নদী-খালের সাথে যুক্ত৷ অল্প জোয়ারে ভেসে যায় অনেক এলাকা৷ এবারে সেই জোয়ারের উচ্চতাও বেশি৷ তার সাথে যুক্ত হয়েছে বৃষ্টি৷ নগরীর আবর্জনায় ভরা ড্রেন, দখল হয়ে যাওয়া খাল পরিস্থিতিকে করেছে শোচনীয়৷ ডয়চে ভেলের সাথে আলাপে চট্টগ্রামের এই প্রকৌশলীর মুখে উঠে এসেছে এ সব কারণ৷
তিনি বলেন, ‘‘বৃষ্টিপাতের পানি এবং দৈনন্দিন ব্যবহারের পানি নামার জন্য যে নালা, সেটা সংকীর্ণ হয়ে গেছে৷ হয়েছে অপদখলও৷ বদ অভ্যাসের কারণে আমরা ড্রেনকে ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছি৷''
শুধু তাই নয়, ড্রেন ভরে যাওয়ার জন্য পাহাড় থেকে ক্ষয়ে আসা বালুকেও দায়ী করেছেন তিনি৷ তাঁর কথায়, ‘‘অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহরের কিছু কিছু এলাকা সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে আড়াই থেকে তিন মিটার উঁচু৷ কিন্তু এখানে সাড়ে ৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে জোয়ার আসার ইতিহাস রয়েছে৷''
দেলোয়ার জানান, গতকাল এখানে জোয়ারের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮৮ মিটার৷ সে কারণে শহরে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে৷ এ সময় ড্রেনের পানিও নদী বা সাগরে নামতে পারে না৷ ড্রেনগুলো ভরাট হয়ে সক্ষমতা হারানোর কারণে ভাটা পড়লেও সেই সময়টা ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারে না৷ তখন দেখা যায় কর্ণফুলী খালি, কিন্তু পানি নামতে পারছে না৷
চট্টগ্রামের এই সমস্যা সমাধানে ১৯৯৫ সালে করা মাস্টার প্ল্যানে ফিরতে বললেন এই প্রকৌশলী৷ বলেন, ‘‘এটা চমৎকার একটা মাস্টার প্ল্যান৷ এটা সংসদেও অনুমোদিত হয়েছে৷ কিন্তু এখন কেউ এটাকে ধারণ করে না৷'' এখানে পাহাড় থেকে আনা বালি ব্যবস্থাপনার কথাও বলা হয়েছে৷
দেলোয়ারের নিজের ভাষায়, ‘‘ড্রেন-খাল অপদখলকে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ কোথাও পর্যাপ্ত খাল না থাকলে খনন করার কথা বলা হয়েছে৷ একইভাবে বৃষ্টি ও জোয়ার ব্যবস্থপনার কথা বলা হয়েছে৷''
‘‘বৃষ্টি এবং জোয়ার একসাথে হলে জোয়ারকে নগরীর বাইরেই আটকে দেয়া এবং বৃষ্টির পানির সরিয়ে নিতে জলাধার নির্মাণের কথা বলা হয়েছে এখানে৷ খুব প্রতিকূল অবস্থার জন্য পাম্প রাখার প্রস্তাবও রয়েছে এতে৷''
‘‘পানির লাইন, গ্যাস লাইন যে সব প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে, সেটা অপসারণ করতে বলা হয়েছে৷ আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এটা বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম নগরীর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷''
বর্তমানে প্রতি বছর ৫০০-৭০০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ দিলে ১২ বছরে এই মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করা যাবে বলেও নিজের হিসাব তুলে ধরেন তিনি৷ এছাড়া এই সমস্যার সমাধান না হওয়ার পেছনে ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছাকে' কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন দেলোয়ার৷ চট্টগ্রামের সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায়ও এই সমস্যা সমাধানে বাধা হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করেন তিনি৷
আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও কিভাবে কাজকে পিছিয়ে দেয়, তাঁর দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বিগত মেয়রের আমলে বড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত একটি খাল খনন প্রকল্প পাস হয়ে আসে৷ এটি এখনো শুরুই হয়নি৷
‘‘এ জন্য ভূমি অধিগ্রহণের বিষয় আছে৷ এ জন্য পুরো টাকা হাতে না পেলে জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে না৷ আর অর্থ মন্ত্রণালয় পুরো টাকা এক সাথে ছাড় দেয় না৷''
‘‘সময় চলে গেলে রিভাইজড প্রকল্প পাঠাতে হয়৷ তখন পাস হয়ে আবার খন্ডিত টাকা আসে৷ তখন আবার একইভাবে অধিগ্রহন আটকে যায়৷''
তিনি বলেন, অন্যান্য সেবাদানকারী সংস্থাগুলো তাদের কাজের মাধ্যমে অনেক সময় পানি নামার পথে বাধা সৃষ্টি করে, তাদের উপর সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণ নেই৷
‘‘ইদানীং নতুন একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে৷ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ নানা প্রকল্প নিচ্ছে৷ এতে প্রজেক্ট ওভারলেপিং হবে৷ কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আগে হয়ে যেতে পারে৷ এই ধরনের নতুন একটি সংকট দেখা দেখা দিচ্ছে৷ এ কারণে মনে হচ্ছে, চটগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রলম্বিত হবে৷''
সমস্যা সমাধান পথ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে৷ পর্যাপ্ত তহবিল দিতে হবে৷ ভূমি অধিগ্রহণে হয় সরকার সমুদয় অর্থ একত্রে দেবেন বা সমুদয় অর্থ না দিয়েও যাতে কাজ শুরু করা যায় সেই ব্যবস্থা করবেন৷
‘‘সিটি কর্পোরেশন প্রকল্প নিলে ৩০ শতাংশ নিজেদের অর্থায়ন করতে হয়৷ বর্তমানে ১৬শ' কোটি টাকার প্রকল্প পাইপলাইনে আছে৷ তাঁর জন্য ৪০০ কোটির বেশি টাকা দিতে হবে৷ এই সামর্থ্য তাদের নেই৷''
তাই ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করার আহ্বান জানান তিনি৷ বলেন, এটা বাস্তবায়নে সরকারকে সিটি কর্পোরেশনের পাশে দাঁড়াতে হবে৷ আইনি জটিলতা দূর করতে হবে৷ পর্যাপ্ত বাজেট দিতে হবে৷ তাতে তিন বছরে সহনীয় পর্যায়ে আনা যাবে৷ সাত বছরে মোটামুটি মুক্ত হতে পারবো৷ ১২ বছরে ৫০-৬০ বছরের জন্য এই নগরকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব৷
দেলোয়ার হোসেন বলেন, এ শহরের বিরাট অংশের মালিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ৷ বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং সশস্ত্র বাহিনীও বিশাল বিশাল অংশের ভূমির মালিক৷ এদেরকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে৷ তাঁর কথায়, ‘‘রাস্তাঘাট নষ্ট করবে সবাই, আর মেরামত করবে সিটি কর্পোরেশন৷ এটা হতে পারে না৷ বন্দরের কারণে এখানে মানুষ আসে৷ গাড়ি আসে৷ নর্দমা ভরে যায়৷ তারা দায়িত্ব নেয় না৷ তাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে৷ তাদেরকে দায়িত্ব নিতে হবে৷ অথবা আয়ের একটা অংশ সিটি কর্পোরেশনকে দিতে হবে৷ এখন তারা কেবল ভূমিকর দিচ্ছেন৷''