ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতির লোকায়ত কিছু পদ্ধতি
২৩ এপ্রিল ২০১৮আধুনিক পূর্বাভাস প্রযুক্তি আবিষ্কারের আগে উপকূলের মানুষজন কীভাবে ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা পেত?
গুমোট আবহাওয়া, আকাশের মেঘ এবং সাগর ও নদীর মোহনায় পানি বৃদ্ধি দেখে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের উপকূলের মানুষ বুঝে নিত বড় ধরনের ঝড় আসছে৷ হয়ত জেলেরা সতর্ক হতেন, তীরে ফেরার চেষ্টা করতেন৷ জেলেরা যখন ফিরতেন তখন নৌকার গলুইয়ে পতাকার মতো কাপড় ঝুলিয়ে রাখতেন, যাতে অন্য জেলে নৌকাগুলো বিপদ সম্পর্কে জানতে পারে৷
আর উপকূলের মানুষ কীভাবে পেত সেই সংকেত?
২০০৩ সালে প্রকাশিত গবেষক ফিলিপা হাওয়েলের গবেষণাপত্র ‘ইনডিজেনাস আর্লি ওয়ার্নিং ইনডিকেটরস অফ সাইক্লোনস: পটেনশিয়াল অ্যাপ্লিকেশন ইন কোস্টাল বাংলাদেশ'-এ প্রযুক্তির বাইরে কীভাবে লোকায়ত জ্ঞান দিয়ে উপকূলের মানুষ ঝড়ের আগাম বার্তা বুঝতে পারত, সে সম্পর্কিত তথ্য জানতে, বেশ কয়েকজন উপকূলবাসীর অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়৷ এদের অনেকেই ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা থেকে বড় ধরনের ঝড় আসার প্রাকৃতিক আগাম সতর্কতাগুলো নিজেদের স্মৃতি থেকে বর্ণনা করেছেন৷
এখানে গবেষক ফিলিপা ভোলায় ‘অ্যাকশন এইড' পরিচালিত একটি জরিপের উদাহরণ টেনেছেন৷ ভোলার আওতাভুক্ত ঢাল চর, চর কুকড়িমুকড়ি, চর মোতাহার এবং চর জহিরুদ্দিনের ৯৬ জন বয়োবৃদ্ধের উপর জরিপ চালানো হয়৷ যাদের কাছ থেকে ১৯৭০ সালের ২৯ এপ্রিল পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়ের আগে প্রাকৃতিক পরিবর্তনগুলো কী কী ছিল, তা জানতে চাওয়া হয়েছিল৷
তাঁরা উত্তরে বলেছিলেন, আকাশ ধূসর ছিল, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে জোরালো হাওয়া বইছিল, আবহাওয়া অস্বাভাবিক গরম ছিল, একদিন আগে পুকুরের পানি গরম হয়ে গিয়েছিল এবং নদীতে অস্বাভাবিক বড় বড় ঢেউ তৈরি হয়েছিল৷
এছাড়া প্রাণিজগতেও পরিবর্তনের কথা বলেছেন এসব চরের মানুষেরা৷ তাঁরা জানিয়েছেন, গবাদিপশুগুলো তিন থেকে সাত দিন আগে থেকেই ছটফট করছিল৷ ঘাস খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল৷ শঙ্খচিলগুলো তারস্বরে চিৎকার করছিল৷ পোকামাকড়ের উপদ্রব হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিলো সেসময়৷ আর কুকুর সমানে কাঁদতো ভয়াল সে দুর্যোগের আগের কয়েকদিন ধরেই৷ পিঁপড়ারা ডিম পিঠে গাছে ওঠা শুরু করেছিল৷
ফিলিপা হাওয়েল ও অ্যাকশন এইডের ঐ জরিপ থেকে অতীতে উপকূলের মানুষজন ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের খবর কীভাবে আগে জানতো, তার মোটামুটি একটা আন্দাজ পাওয়া যায়৷
কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি কমানোর ব্যাপারে তাদের উদ্যোগ কী থাকত, সেই বিষয়টি পাওয়া যায় ইউএসএআইডি পরিচালিত আরেকটি গবেষণা থেকে৷
‘লোকাল উইজডম: ইনডিজেনাস প্র্যাকটিসেস ফর মিটিগেটিং ডিজাস্টার লস' নামের ওই গবেষণায় কিছু লোকায়ত জ্ঞান দিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার চিত্র দেখানো হয়েছে৷
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব থেকে বাঁচতে সম্ভাব্য মাছ শিকারের নৌকার পাশে বাড়তি ভেলা বেঁধে রাখতেন অনেকেই৷ বাড়িঘরগুলোর চালা নতুন করে বাঁধতেন৷ ছাদের চার কোণায় ভারি কিছু ঝুলিয়ে দিতেন বা পুরো চালই ভারি কিছুর সাথে বাঁধতেন৷ ভারি বস্তুগুলো একে অপরের সাথে বেঁধে রাখাও একটা কৌশল ছিল৷ খাবার এবং পানি মাটির নীচের মশকে ভরে রাখতেন, যাতে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে এ সবের সংকটে পড়তে না হয়৷
এছাড়া অ্যাকশন এইড-এর জরিপ ও ফিলিপা হাওয়েলের গবেষণা থেকেই জানতে পারা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের আঁচ পেলে হাতের কাছে প্রচুর ডাব বা নারকেল পেড়ে রাখা হত, যাতে একদিকে দুর্যোগের পরে পানির সংকট মিটতো, অন্যদিকে আচমকা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে সেগুলো জীবনরক্ষাকারী বয়া হিসেবে কাজ করত৷
এখনকার আবহাওয়া ও জলবায়ু বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে৷ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুর্যোগ ও ত্রাণ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়৷ তবু অতীতের দুর্যোগ মোকাবেলার লোকায়ত পদ্ধতি নিয়েও প্রচুর কাজ হচ্ছে৷ কেননা নানা ধরনের সতর্কতা সংকেত দেখিয়ে ও ব্যবস্থা নিয়েও উপকূলের মানুষকে নিজের বাড়িঘর থেকে সরানো কঠিন হয়ে পরে৷
তাদের অনেকে গবাদি পশু আর ভিটেমাটির মায়ায় শেষ পর্যন্ত বাড়ি ছাড়েন না৷ তাছাড়া বিশ্বের ভয়াবহতম ঝড়গুলোর সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে করতে অনেক উপকূলের মানুষের মধ্যেই একটি বেপরোয়া একরোখা ভাব চলে এসেছে৷ অনেকটা ‘যা হওয়ার হবে' ধরনের!
এক্ষেত্রে গবেষকরা স্বল্প খরচের লোকায়ত পদ্ধতিতে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করছেন৷ তবে বড় ধরনের ঝড়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা সংকেত পাওয়ামাত্রই উপকূলের মানুষ সরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই৷
ঘূর্ণিঝড়ের আভাস পাওয়ার আর কোনো লোকায়ত পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন কি? লিখুন নীচের ঘরে৷