‘ঘটনা সত্য’ এবং বাংলাদেশে নাটকের আড়ালের সত্য
৩০ জুলাই ২০২১‘ঘটনা সত্য’ একটি টিভি নাটক৷ ঈদুল আজহায় প্রচারিত সেই নাটকে বার্তা দেয়া হয়েছে, পাপ করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়৷ দেখানো হয়েছে চুরি করে জীবন নির্বাহ করা দম্পতির ঘরে জন্ম নেয় ‘বিশেষ শিশু’৷ জনপ্রিয় জুটি আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী অভিনীত এই নাটকে দেয়া এমন বার্তাকে ঘিরে ঝড় ওঠে সোশাল মিডিয়ায়৷ উঠে আসে নিজেদের ‘বিশেষ শিশু’ হিসেবে জন্ম নেয়া সন্তান আছে এমন বাবা-মায়েদের ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশার কথা৷সারা বিশ্বে যখন অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের ‘স্পেশাল চাইল্ড’, অর্থাৎ ‘বিশেষ শিশু’ বলে তাদের শারীরিক এবং মানসিক সক্ষমতার স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে, তখন জনপ্রিয় তারকাদের নিয়ে নির্মিত নাটকে এমন দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করাকে ‘অমানবিক’ বলছেন সবাই৷
তীব্র সমালোচনা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিএমভি নাটকটি ইউটিউবসহ অনলাইনের সব মাধ্যম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়৷ নাটকের পরিচালক, প্রযোজক, শিল্পী ও কলাকুশলীরা যৌথ বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশও করেন৷ নাটকটির নির্মাতা রুবেল হাসান ডয়েচে ভেলের কাছেও দুঃখ প্রকাশ করেছেন৷
তবে ‘ঘটনা সত্য’ নাটকটিকে ঘিরে শুরু হওয়া সমালোচনা এখনো চলছে৷ ১৪টি সংগঠনের মোর্চা ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গ্যানাইজেশন (এফটিপিও) বুধবার (২৮.০৭.২১ইং) ‘ঘটনা সত্য’ নাটকে প্রচারিত বার্তাকে ‘আপত্তিকর’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছে পুরো বিষয়টিতে ‘দায়িত্বহীনতার পরিচয়’ দিয়েছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান৷
তারপরই (বৃহস্পতিবার) নিজের ফেসবুক পেজে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দিয়ে আফরান নিশো জানিয়েছেন তিনি ‘দুঃখিত, লজ্জিত, বিব্রত এবং অনুতপ্ত’৷
নাটকটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দাবি, ঘটনাটি অসাবধানতাবশত ঘটেছে৷ অন্যদিকে অভিনয় শিল্পী সংঘ জানিয়েছে, নাটকটির আপত্তিকর সংলাপের বিষয়ে প্রধান দুই অভিনয় শিল্পী আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী কিছুই জানতেন না৷
অবনমনের ধারা
‘ঘটনা সত্য’ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলেও গণমাধ্যম ‘বিশেষ শিশু’দের প্রতি অনেক দিন ধরেই অসম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে আসছে বলে মনে করেন ডা. আব্দুন নূর তুষার৷ তিনি বলেন, ‘‘এই মাধ্যমগুলোতে ‘অটিজম’ বা ‘অটিস্টিক’ শব্দটাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, ‘বিশেষ শিশু’দের কৌতুকপ্রদ চরিত্রে পরিণত করার চেষ্টা করা হয়েছে বহু সিনেমা, বহু নাটকে৷ এরই ধারাবাহিকতার ফসল এই নাটক৷’’
অভিনেতা তারিক আনাম খান ‘এই রুচিহীন’ জায়গায় পৌঁছানোর জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী না করে বলছেন, ‘‘আস্তে আস্তে এই অবস্থাটা হয়েছে৷ একটা সময় শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল আমাদের শিল্পমাধ্যমে৷ আমাদের নাটক ছিল সাহিত্য-নির্ভর, মানবিক গল্প আর উত্তোরণের গল্প- নতুন চিন্তা-ভাবনার মিশেল৷ বর্তমানে আমরা সবকিছু পণ্য বানিয়ে ফেলেছি৷ কিন্তু পণ্যও তো মানসম্পন্ন হওয়া চাই৷ টাকা উপার্জন মুখ্য উদ্দেশ্য হলে স্বপ্ন, আকাঙ্খার জায়গা থাকে না৷’’
ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অর্গ্যানাইজেশন (এফটিপিও)-এর চেয়ারম্যান, নাট্যজন মামুনুর রশীদ নাটকে স্পর্শকাতর বিষয়ে দায়িত্বহীনতা প্রকাশের জন্য দায়ী করেন ‘শিক্ষার অভাব’কে৷ তার মতে, ‘‘যারা পরিচালনা করছেন, যারা চ্যানেলের দায়িত্ববান, তারা সবাই দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছেন৷’’
ক্ষোভ আর হতাশার কথা জানিয়ে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী ডয়েচে ভেলেকে জানান, এই দৈন্যের কথা তিনি বলতে বলতে ক্লান্ত৷ তিনি বলেন, ‘‘সবাই ভিউর পেছনে ছুটছে৷ অর্থই সবকিছু কিনে নিচ্ছে৷’’
নাটক এবং টুট টুট ট্রেণ্ড...
নির্মাতা মাসুদ সেজান অকপটে বললেন, ‘‘নির্মাতা হিসেবে পরিচয় দিতে আমার কুন্ঠা হয়৷ লজ্জা পাই৷ এর কারণ, শিল্প করতে এসে শিল্পের ধারেকাছেও আমরা নেই৷ আমরা শিল্প থেকে দূরে সরে গেছি৷’’
চঞ্চল চৌধুরী এর জন্য নাটক নির্মাণের ব্যয়কেও গুরুত্বপূর্ণ কারণ মনে করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আগে একটি নাটক নির্মাণে বাজেট থাকতো ৭/৮ লাখ টাকা, এখন তা দেড় লাখ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ তাতে কারো কারো লাভ হলেও নাটকের মানের বারোটা বেজেছে৷’’
তবে মাসুদ সেজান মনে করেন এর পেছনে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোরও দায় আছে, ‘‘একটা শ্রেণি, যারা টেলিভিশন চালাচ্ছেন, তারা এখন কয়জন তারকার নাম বলে দেয়৷ যে কেউ তাদের নিতে পারলেই পরিচালক বনে যান৷ তারকার শিডিউল পাওয়াই পরিচালকের যোগ্যতা৷’’
এই নির্মাতা আরো বলেন, এখন ‘‘ন্যাক্কারজনক জুটি প্রথা চলছে৷’’ তার মতে, একজনের শিডিউল নিলে আরেকজনের শিডিউল মেলে, নায়িকার শিডিউল নিলে নায়ক পাওয়া যায়, তারা নিজেদের মতো স্ক্রিপ্ট সাজায়, পরিচালকের কাজ শুধু ‘কাট’ বলা৷ আর রয়েছে ‘ডিওপি’-ডিরেক্টর অব ফটোগ্রাফি৷ মাসুদ সেজানের কথায়, ‘‘কাটিং পয়েন্ট না বোঝা পরিচালক তাদের গিয়ে ধরেন৷ ডিওপি তাদের ডিরেক্টর বানিয়ে দিচ্ছেন৷ আর নাটকের এখনকার ট্রেণ্ড ‘…টুট টুট’৷ নাটকে এটা না থাকলে হিট হবে না৷ রয়েছে কিছু এজেন্সি, কিছু চ্যানেল-যারা এমন চাটুকার আর ব্যাকবোনলেস ডিরেক্টর খোঁজেন৷ এমনই জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি আজ নাটকের৷’’
হতাশা ছাপিয়ে আশার কথা
নাটকে নির্মাণশৈলীর উৎকর্ষতার পাশাপাশি আধুনিক এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চিত করা তাহলে কিভাবে সম্ভব?
তারিক আনাম খান বলেন, ‘‘এখানে বেশি প্রয়োজন এডুকেশনাল ট্রেনিং৷ তবু আশার কথা, আমাদের সিনেমা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে৷ উন্নত বোধ, চেতনার দেখা মিলছে আমাদের নতুন প্রজন্মের হাতে তৈরি সিনেমায়৷ আশার আরেকটি জায়গা, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম৷ মাধ্যমটি ঘিরে মেধাবী নির্মাতারা স্বপ্ন দেখছে৷ এটিকে হারালে চলবে না৷ এখানে আমাদের চিন্তা, চেতনার স্বাধীনতা থাকতে হবে৷’’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যাণ্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সানজীদা আখতার মনে করেন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে উন্মুক্তভাবে অসংখ্য নাটক প্রচারের এই সময়ে সব পর্যায়ে বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন নিশ্চিত করা প্রয়োজন৷ তিনি বলেন, ‘‘নাটক বা সিনেমায় নারীবিদ্বেষী বক্তব্য, শিশুর জন্য ক্ষতিকর এমন বক্তব্য, যে কোনো সম্প্রদায় বা বিভিন্ন শারীরিক গঠনের মানুষের বিষয়ে অবশ্যই সংবেদনশীল হওয়া উচিত৷ কিন্তু তা হচ্ছে না৷ এজন্য জরুরি মনিটরিং৷’’