গ্যাস, বিদ্যুতের সংকটে ভুগছে পোশাক শিল্প
৩১ মে ২০২৩বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ডলারের অভাবে কয়লা ও এলএনজি আমদানি সংকটের মুখে পড়ায় এই পরিস্থিতি। এই সংকট আরো কয়েকমাস চলবে। এখন ভরসা বৃষ্টির ওপরে। বৃষ্টি হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমে।
এর ফলে গৃহস্থালিতে বিদ্যুৎ গ্যাস ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষেরা যেমন কষ্টে আছেন, তেমনি শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। দিনে চার-পাঁচবার লোডশেডিং করা হচ্ছে। শিল্প মালিকরা বলছেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর যেগুলো চালু আছে সেগুলো উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি ব্যবহার করতে পারছে না।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে
করোনা মহামাারির অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্বের অর্থনীতিই চাপে পড়েছে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি, ডলার ও রিজার্ভ সংকটের সঙ্গে চলছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট। গ্যাস ও কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ উদপাদন চাহিদার চেয়ে অনেক কম।
তারপরও এবারের বাজেট হবে অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আকারে বড়। সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার এই বাজেটে ঘাটতি হলো দুই লাখ ৬১ হাজার টাকা। রাজস্ব খাত থেকে আসবে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। বাকি অর্থ বৈদেশিক ঋণ এবং দেশের আর্থিক খাত থেকে ঋণ নিয়ে মিটাতে হবে।
কয়লা আর গ্যাসের অভাব
কয়লার অভাবে গত ২৩ এপ্রিল রাত থেকে উৎপাদন বন্ধ আছে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চলমান একটি ইউনিটের (৬৬০ মেগাওয়াট)। ২৫ এপ্রিল থেকে বন্ধ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্ট ইউনিটের উৎপাদন। ২৯ এপ্রিল উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের বৃহৎ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ার ২৭৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার তৃতীয় ইউনিটটিও বন্ধ হয়ে যায়। আর পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে আগামী দুই দিনের মধ্যে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মুখপাত্র শামিম হাসান জানান, " আজ (বুধবার) সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আছে ১৫ হাজার ২০০ মেগাওয়াট আর উৎপাদন সক্ষমতা আছে ১৫ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। ১৮৯ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে। এবে এটা দিনের পরিকল্পনা। রাতে বোঝা যাবে প্রকৃত পরিস্থিতি।”
তিনি বলেন, " পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটের উৎপাদন শুক্রবার থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কয়লা না থাকার কারণে। আরেকটি আগে থেকেই বন্ধ আছে। আজকেও যদি আমরা কয়লা আমদানির জন্য এলসি খুলি, তাহলে কয়লা আনতে কমপক্ষে এক মাস সাত দিন লাগবে। তার মানে, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আমরা আগামী এক মাস বিদ্যুৎ পাচ্ছি না।” এই কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেতো। ফলে এটা বন্ধের পর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
শামিম হাসান আরো বলেন, " আমাদের কিছু করার নেই। ডলার না পেলে আমরা কয়লা আনবো কী দিয়ে। পায়রার জন্য আমাদের কয়লা আমদানিতে দরকার ৪০ কোটি ডলার। কিন্তু আমাদের পাঁচ কোটি ডলার দিলে আমরা কয়লা আনবো কীভাবে?”
বাংলাদেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১৫৩ টি। ৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ আছে। তেল ভিত্তিক কেন্দ্রগুলো আগেই বন্ধ করা হয় জ্বালানি তেলের অভাবে। ভরসা ছিল কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো। শামিম হাসান জানান, " আমাদের কেন্দ্রগুলোতে দিনে গ্যাসের চাহিদা এক হাজার ৪০০ এমএমসিএফটি। কিন্তু আমরা পাই গড়ে গড়ে ৮০০ এমএমসিএফটি। আমরা সক্ষমতার অর্ধেক বা তার চেয়ে কিছু বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি।”
তার কথা, "বিদ্যুতের এই সংকট কমপক্ষে আরো এক মাস চলবে। এখন ভরসা বৃষ্টি। বৃষ্টি এলে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। কারণ, তখন গরম থাকে না। চাহিদা চার-পাঁচ হাজার মেগাওয়াট কমে যাবে।”
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট।সক্ষমতার ৪৭ শতাংশ গ্যাসভিত্তিক। গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ১১ হাজার ৩৯ মেগাওয়াট। ফার্নেস অয়েল ও ডিজেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা সাত হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা তিন হাজার ৪৪০ মেগাওয়াট। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে জ্বালানি তেল, কয়লা ও এলএনজি আমদানি ব্যাহত হওয়ায় সক্ষমতার ৩০-৪০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
শিল্প উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে
তৈরি পোশাক শিল্পসহ বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলো এখন দিনে গড়ে ৮-১০ ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। যা পায় তা-ও নিরবচ্ছিন্ন নয়। তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, "আমরা বিদ্যুতের সঙ্গে গ্যাস সংকটেও আছি। সাব কন্ট্রাটিং কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। আর বড় কারখানাগুলো সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি উৎপাদন করতে পারছে না।”
তিনি জানান," ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপের বাজারে সংকট হলেও আমরা বিকল্প বাজার পেয়েছি। কিন্তু উৎপাদন তো লাগবে। আমরা তো উৎপাদন করতে পারছি না। তাই এখন আমরা বিকল্প জ্বালানি রিনিউয়েবল এনার্জির কথা ভাবছি।”
নিট পোশাক প্রস্তুতকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, " আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ পেতে গ্যাসের ১৭৮ শতাংশ দাম বৃদ্ধি মেনে নিয়েছিলাম। শর্ত ছিল আমাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস বিদ্যুৎ দেবে। কিন্তু আমরা এখন ঠিকমতো গ্যাস, বিদ্যুৎ পাচ্ছি না। আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এখন লাভের চেয়ে লোকসান কত কমাতে পারি সেই চিন্তায় আছি।”
এফবিসিসিআইর সাবেক পরিচালক মো. হেলালউদ্দিন বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে সব শিল্পেরই খারাপ অবস্থা। উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো শিল্প বন্ধ হওয়ার পথে।
সরকার আইএমএফের চাপে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহারের পথে হাঁটলেও নতুন বাজেটেও ভর্তুকি থাকছে।
আগামী অর্থবছরে মোট ভর্তুকি বরাদ্দ থাকবে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বাজেটে যা ছিল ৮১ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতে ২৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হতে পারে, যা বিদায়ী অর্থবছরে ছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। গ্যাস ব্যবহারকারীদের জন্য ভর্তুকি থাকছে ছয় হাজার কোটি টাকা।