গ্যাস দুর্ঘটনার অভিশাপ তিন প্রজন্ম ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে ভোপাল
২ ডিসেম্বর ২০১৪৪০ টন এমআইসি বা মিথাইল আইসো-সায়ানেটের মতো অতি বিষাক্ত গ্যাসে ঐ এলাকার মাটি, ভূগর্ভস্থ জল ও বাতাস বিষিয়ে যায়৷ আজ ৩০ বছর ধরে সেই অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে পরবর্তি তিন প্রজন্মকে৷ সবথেকে ক্ষতি হয়েছে সেখানকার মেয়েদের৷ তাঁরা জন্ম দিয়ে চলেছে বিকৃত ও জন্মগত দুরারোগ্য ব্যাধির সন্তান৷ মনের ক্ষুব্ধ প্রশ্ন কার পাপে? কার দোষে তাঁদের এই কষ্ট, যন্ত্রণা? কোম্পানির কর্তৃপক্ষের অবশ্যই! কিন্তু সরকারও কি পারে দায় এড়াতে?
আমাকে সবথেকে যা বিস্মিত করে, এতবড় বিপর্যের জন্য যে সংস্থা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী, সেই সংস্থার শীর্ষ ব্যক্তি অ্যান্ডারসনকে দুর্ঘটনার পর পরই গোপনে সরকারি বিমানে দিল্লিতে এনে ভারত থেকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয় তখনকার রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার৷ এই মারাত্মক দুর্ঘটনার পরিণাম আঁচ করেই হয়ত সেটা করা হয়েছিল৷ যার জন্য আদালতে মামলা ওঠার পর অভিযু্ক্তদের কাউকে হাজির করা যায়নি৷ তাঁদের বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবার জন্য সরকারের তরফে সাফাই দেয়া হয় আন্তর্জাতিক বিধিনিয়মের কূটকচালির৷ বলা হয়, এর জন্য দরকার প্রত্যর্পণ চুক্তি৷ কী হাস্যকর যুক্তি!
এতগুলো মানুষ মারা গেল৷ এতগুলো মানুষকে যেখানে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে মারাত্মক অসুখের উপসর্গ, সেখানে আন্তর্জাতিক নিয়মবিধির দোহাই দিয়ে অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাবে৷ এ কেমন কথা৷ যদি দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তির তোলা হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক আদালত বা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আছে কী করতে? সেখানেও তো তোলা যেতে পারতো৷ আসলে তাঁরা তো অতি সাধারণ মানুষ৷ কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ না বেরিয়ে পড়ে, খোদ সরকারকে না পড়তে হয় বিপাকে৷
আরো অবাক লাগে বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলির ভূমিকা নিয়ে৷ শুরুর দিকে কিছু হৈচৈ হয়েছিল বটে, কিন্তু তারপর সবাই চুপ কেন? চুপ কেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন? তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে তারা তোলপাড় করে, ভোপাল গ্যাস পীড়িতদের জন্য নয় কেন? সন্দেহ জাগে অভিযুক্ত কোম্পানিটা ছিল উন্নত বিশ্বের প্রভাবশালি দেশ, তাই বলে কি তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে? কোনো ভারতীয় কোম্পানি যদি এটা মার্কিন ভূখণ্ডে করতো, তাহলে কি তাদের ছেড়ে দেয়া হতো? কখনই না৷ যেমন বিপি কোম্পানির তেল লিকের ফলে মেক্সিকো উপসাগরের জল দূষিত হয়ে গেলে ওবামা প্রশাসন ঐ কোম্পানির কাছ থেকে কান মুলে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দুই হাজার কোটি ডলার৷ আর ভারত সরকার তার দায় ঝেড়ে ফেলে নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে৷
ক্ষতিপূরণের বহরটা একবার শুনবেন? পাঁচ সদস্যের এক পরিবারকে মাসে মাত্র ২০০ টাকা৷ অসুস্থ ও পীড়িত মানুষদের চিকিতসার ব্যবস্থা আরো করুণ৷ বর্ধিত ক্ষতিপূরণের দাবিতে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংসদের অদূরে ধর্ণা ও অনশনে বসেছিল ভোপাল গ্যাস পীড়িত কিছু মহিলা৷ সপ্তাহ খানেক পর পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়৷ গত ৩০ বছরে রাজ্যে ও কেন্দ্রে কত সরকার এলো, কত সরকার গেল, কেউ কথা শোনেনি, কেউ কথা রাখেনি৷ বিচারের বাণী তাই নীরবে নিভৃতে কাঁদে৷
বেসরকারি হিসেবে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনায় মারা যায় প্রায় ২৪-২৫ হাজার মানুষ৷ দেহে নানান দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয় প্রায় পাঁচ লাখের মতো৷ সরকারের মতে অবশ্য মৃতের সংখ্যা ধরা হয় মাত্র ৩৭৮৭৷ ২০০১ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কিনে নেয় আরেক মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি ডো কেমিকেলস৷ তাদের নীতি স্রেফ মুনাফা, ক্ষতিপূরণের দায় নিতে তারা অস্বীকার করে৷ মানবিকতার দায় তো দূর অস্ত৷ এমনকি ঐ কারখানার বিষাক্ত মাটি ও ভূগর্ভস্থ জল শোধন করারও কোনো উদ্যোগ নেয়নি ডো কেমিকেলস৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অবশ্য দাবি জানিয়েছে ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনা এলাকার প্রকৃত দুষণ মাত্রা নির্ধারণে জাতিসংঘের দূষণ কর্মসূচির মাধ্যমে নিরপেক্ষ দূষণ অডিট কেন করা হচ্ছে না? একটা কথাই মনে হয়, ন্যায়বিচার শব্দটা কি পৃথিবী থেকে মুছে গেছে? নাকি দরকার মতো সেটা ব্যবহার করা হয়? মানবিকতার ক্ষেত্রে এ দ্বিচারিতা কেন?