গৃহকর্মীদের কান্না শোনার কেউ নেই
১৭ নভেম্বর ২০১৯মানবাধিবার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট (জানু-অক্টোবর) মাসে ৩২ জন গৃহকর্মী নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে ১১ জন নিহত হয়েছেন৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১২ জন৷ অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকারও হয়েছেন গৃহকর্মীরা৷ কিন্তু এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ১৫টি৷ নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে৷
ঢাকাসহ সারাদেশে যারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন তাদের ৯০ ভাগেরও বেশি নারী৷ এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা ১৮ বছরের নীচে৷ জরিপে দেখা গেছে যারা হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয় তাদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে৷ তারপরেই রয়েছে সাত থেকে ১২ বছরের শিশুরা৷
২০১৮ সালে ১৮ জন গৃহকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন৷ আত্মহত্যা করেছেন পাঁচজন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন চার জন৷ মোট নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫৪টি৷ কিন্তু ২২টি ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি৷ ২০১৭ সালে নিহত হন ১৯ জন, ধর্ষণের শিকার হন সাত জন৷ ৪৩টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও মামলা হয়েছে মাত্র ২৫টির৷ ২০১৬ সালে সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছেন৷ ৪০ জন নিহতের মধ্যে ১৮ জনই ছিল শিশু৷
আসকের এই হিসাব কয়েকটি নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে করা, কিন্তু বাস্তব চিত্র অনেক ভয়াবহ৷ কারণ অনেক নির্যাতনের ঘটনায় অর্থ ও চাপের মুখে সমঝোতা করা হয়৷ গৃহকর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দরিদ্র হওয়ায় তারা মামলা মোকদ্দমায় যেতে চান না বা যেতে সাহস পান না৷ প্রভাবশালীরা অনেক নির্যাতনের ঘটনাই ধামাচাপা দিয়ে ফেলেন৷
গত মার্চে আইএলও বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাতে বলা হয়, যারা বাড়িতে সার্বক্ষণিক গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন তাদের শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন৷ মানসিক নির্যাতনের শিকার হন প্রায় ২৬ ভাগ৷ যৌন নির্যাতনের শিকার হন তিন ভাগ৷ আর তীব্র মৌখিক নির্যাতনের শিকার হন শতকরা ৪৮ ভাগ৷ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাতে ঘুমনোর সময় ৬৬ ভাগ গৃহকর্মীই নিজেদের নিরাপদ মনে করেন না৷
আইএলও বলছে, বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের শতকরা ৯৭ ভাগ নারী৷ আর যে তিন শতাংশ পুরুষ তাদের প্রায় সবাই ছেলে শিশু৷
গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করে ‘শ্রমিক জোট বাংলাদেশ'৷ এই সংগঠনের যুগ্ম আহবায়ক কাজি সিদ্দিকুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৫ সালে বাংলাদেশে গৃহকর্মী সুরক্ষা আইন হলেও তাতে নির্যাতন কমছে না৷ কারণ নির্যাতন হয় ঘরের মধ্যে৷ আর গৃহকর্মী ও তাদের পরিবার গরিব হওয়ায় আইনগত প্রতিকারও পায় না৷ তাদের চাপ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে সমঝোতায় বাধ্য করা হয়৷''
আরেকটি সমস্যা হলো মামলা করলেও সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া কঠিন, যা আগেই নষ্ট করে ফেলা হয় বলে জানান সিদ্দিকুর রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘আসলে এরজন্য প্রয়োজন সচেতনতা৷ যারা গৃহকর্মী নিয়োগ দেন তাদের মানবিক দিক দিয়ে সচেতন করতে হবে৷ এর কোনো উদ্যোগ নেই৷ আমরা গৃহকর্মীদের তাদের অধিকার ও আইনের ব্যাপারে সচেতন করার চেষ্টা করছি৷ কিন্তু গৃহকর্তাদের সচেতনকরবে কে? আমরাতো আর তাদের ঘরের মধ্যে যেতে পারি না৷''
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘যেদেশে আইন ও বিচার ধনীদের নিয়ন্ত্রণে সেখানে গৃহকর্মী নির্যাতনের বিচার ও তাদের সুরক্ষা কঠিন৷ আইন থাকলেও তার কার্যকর প্রয়োগ নেই৷ আর প্রভাবশালীদের কারণে অনেক নির্যাতনের ঘটনাই প্রকাশ পায় না৷''
তিনি মনে করেন, ‘‘গৃহকর্মীদের অভিযোগ গ্রহণ, তাদের আইনি সহায়তাসহ আরো সব সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের সহায়তা সেল থাকা দরকার৷ আর ওই সেলে তারা যাতে অভিযোগ জানাতে পারে তার সহজ ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাহলে যদি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়৷''