1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গর্ভবতী হাতির মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
৪ জুন ২০২০

কেরালায় হাতির মর্মান্তিক মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয়দের। আর সেই মৃত্যু নিয়ে উঠছে অনেক প্রশ্ন। 

https://p.dw.com/p/3dFEW
ছবি: Reuters/A. Abidi

বিস্ফোরক ভরা আনারস মুখে নিয়েছিলো গর্ভবতী বুনো হাতিটি।  কেরালার পালাক্কাড়ে। হাতির মুখেই সেটা ফেটে যায়। হাতির চোয়াল ঝুলে পড়ে। মুখের ভিতরের কিছুটা অংশ জ্বলে যায়। সেই অবস্থায় হাতিটি দুই দিন বেঁচেছিলো। পালের থেকে আলাদা হয়ে। কখনও পালের সঙ্গে। তারপর একটি নদীতে গিয়ে দাঁড়ায় দুর্বল হাতিটি। বন বিভাগের কর্মীরা দুইটি কুনকি হাতি নিয়ে গিয়ে তাকে তোলার চেষ্টা করেছিলো। চিকিৎসাও করেছিলো। ফল হয়নি। গর্ভবতী হাতিটি মারা গিয়েছে।

কোনও সন্দেহ নেই ভয়ঙ্কর ঘটনা।একটা নয়, একমাসের মধ্যে দুটো হাতি এইভাবে বিস্ফোরক ভর্তি ফল খেয়ে মারা গিয়েছে। তারপর শুরু হয়েছে দেশ ও বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া। বিরাট কোহলি, অক্ষয় কুমার, ঋষভ পন্থ, অনুষ্কা শর্মা, রণদীপ হুডা, জন আব্রাহাম, শ্রদ্ধা কাপুর সহ প্রচুর সেলিব্রিটি সামাজিক মাধ্যমে গিয়ে তাঁদের ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন। নিঃসন্দেহে ক্ষুব্ধ হওয়ার মতো ঘটনা। তার প্রকাশও খুব স্বাভাবিক।

তবে কয়েক বছর আগে বলিউডের এক বিখ্যাত তারকার বিরুদ্ধে যখন কৃষ্ণসার হরিণ মারার মামলা হয়, তখন অবশ্য এরকম ঢালাও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।

তবু এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। হাতি বিপন্ন প্রাণী। ২০১৭ সালের গণনার রিপোর্ট হলো, ভারতে এখন ২৭ হাজার ৩১২টি হাতি আছে। লাইভমিন্ট পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, ২০০৯-১০ থেকে ১৬-১৭ পর্যন্ত গড়ে ৮০টি হাতি মারা গিয়েছে। চোরা শিকারির হাতে মারা গিয়েছে ১০১টি হাতি, বিষক্রিয়ায় ৪৪টি, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ৩৯০টি এবং ট্রেনের ধাক্কায় ১২০টি।

এই প্রতিটি হাতির মৃত্যুর পিছনেই মানুষের হাত রয়েছে। আর গত বছর সংসদে একটি প্রশ্নের লিখিত জবাবে বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে হাতির আক্রমণে দুই হাজার ৩০০ জন লোক মারা গিয়েছেন।

ফলে ভারতে মানুষের হাতে এবং তাদের গাফিলতিতে হাতির মৃত্যু নতুন কোনও ঘটনা নয়। প্রতি বছরই মানুষের হাতে বিশালকায় এই প্রাণী আরও বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তাদের অবস্থা বাঘের মতো অতটা সঙ্কটাপন্ন না হলেও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার খাড়া তাদের মাথার ওপরেও ঝুলছে, যদি না মানুষের লোভ ও গাফিলতি বন্ধ করা না যায়।

তবে অন্য চোরাশিকারির হাতে, ট্রেনের ধাক্কায়, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বা বিষক্রিয়ায় হাতির মৃত্যু হলে তো এই রকম প্রতিক্রিয়া হয় না। যেটা হচ্ছে এখন। আসলে এখানে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, যা সকলকে নাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হাতিটি গর্ভবতী ছিলো। ফলে এখানে একজন নয়, আসলে মারা পড়লো দুইটি হাতি। একটি হাতি যে ১৫ বছর বয়সে নির্মমভাবে মারা পড়লো। আরেকটি হাতি যে তার মাতৃগর্ভ থেকে বের হতে পারলো না।

ওই হাতিটি  কারও কোনও ক্ষতি করেনি। খিদের তাড়নায় খেতে ফসল খেতে এসেছিলো। সেখানেই আনারস দেখতে পেয়ে স্বাভাবিক জৈবিক তাড়নায় সেটা মুখের ভিতর পুরে দিয়েছে। তারপর সেই আনারস ফেটে তার জিভ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তারপরেও কাউকে আক্রমণ করেনি।  চুপচাপ এসে নদীর জলে দাঁড়িয়ে পড়েছে। গর্ভবতী হাতির এই অতিমানবিক আচরণ চোখের জল ফেলতে বাধ্য করেছে প্রচুর মানুষকে। ফলে তার প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে।

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশমন্ত্রী প্রকশ জাভড়েকর বলেছেন, পুরো ঘটনার তদন্ত করে দেখবে তাঁর মন্ত্রক। কেরালার সিপিএম মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়নও জানিয়েছেন, তদন্ত করা হচ্ছে। দোষীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। মুশকিল হলো, কেরালায় ফলের মধ্যে বাজি পুরে রাখার ঘটনা এই প্রথম নয়। বুনো শুয়োর এসে যাতে খেতের ফসল নষ্ট করতে না পারে, তার জন্য এই কাণ্ড তারা অনেকদিন ধরেই করছে। এভাবে প্রচুর বুনো শুয়োর মরেছে। বনমন্ত্রী হিসাবে প্রকাশ জাভড়েকর বা মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে পিনারাই বিজয়নের সেটা জানার কথা। তাঁরা এই বীভৎস মরণফাঁদ এতদিন বন্ধ করেননি কেন?  না কি, বুনো শুয়োর মারলে কোনও দোষ নেই? 

বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের থিওরি হলো, একটা কাজ নৈতিক হলে সব ক্ষেত্রে ঠিক হবে, অনৈতিক হলে সব ক্ষেত্রেই ভুল হবে। এ ভাবে কোনও একটি ক্ষেত্রে ঠিক, কোনও একটি ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে না। ফলে বাজি ভরা ফল দিয়ে শুয়োরকে মারাও যতটা অন্যায়, হাতি মারাটাও ততটাই অন্যায়। অথচ, এতদিন বুনো শুয়োর মারা নিয়ে তো কোনও শব্দ শোনা যায়নি?

প্রাক্তন মন্ত্রী মেনকা গান্ধী দাবি করেছেন, ''বনসচিবকে বরখাস্ত করতে হবে, কেরালার বনমন্ত্রীর যদি কোনও কাণ্ডজ্ঞান থাকে তা হলে তিনি পদত্যাগ করবেন, আর রাহুল গান্ধী তো এই এলাকার সাংসদ। তিনি কেন কোনও ব্যবস্থা নেননি?'' ঘটনা হলো, হাতির অমানবিক ও দুঃখজনক মৃত্যু নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা রাজনীতিকে ঢুকিয়ে ফেলা কি ঠিক? ট্রেনের ধাক্কায় হাতি মারা যাওয়ার পর তিনি কি কোনো দিন রেলমন্ত্রীর ইস্তফা দাবি করেছেন? তিনি উত্তর প্রদেশের সাংসদ। উত্তর প্রদেশে এতজন পরিযায়ী শ্রমিকের না খেতে পেয়ে পথ চলার ক্লান্তিতে মৃত্যু হলো, বাস বা ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু হলো, কোনওদিন কারও গাফিলতি নিয়ে মুখ খুলেছেন?

ভবিষ্যতে যাতে এই ভাবে হাতি না মারা যায়, তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। বিষয়টিকে লঘু করে কি কোনও লাভ আছে?

কোনও কোনও ঘটনা বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। গর্ভবতী হাতির এই ভাবে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাই প্রবল প্রতিক্রয়া স্বাভাবিক। আশা করব, এরপর শুয়োর থেকে হাতি, কোনও প্রাণীকেই এরকমভাবে মরতে হবে না। অন্তত সেই সচেতনতাটুকু আসবে।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷