1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গরিব শ্রমিকদের বাড়ি পৌঁছাবার অর্থ সরকারের নেই?

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
৪ মে ২০২০

চল্লিশ দিন পর বাড়ি ফেরার সুযোগ পাচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। কিন্তু বিনা পয়সায় নয়। হতদরিদ্র গরিব শ্রমিকদের কাছ থেকে সরকার ট্রেনের টিকিটের টাকা আদায় করছে।

https://p.dw.com/p/3bkei
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/R. Shukla

কিছুদিন আগে খবরটা টুইট করে জানিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল। তাঁর মন্ত্রক অর্থাৎ, ভারতীয় রেল করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য পিএম কেয়ার তহবিলে ১৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি, রেলের টানাটানির সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। আবার রেলের ভাড়া অনেক চেষ্টা করেও বাড়ানো যায়নি। কারণ, ভাড়া বাড়াবার চেষ্টাটা মূলত করা হয়েছিলো সাধারণ শ্রেণীতে, যেখানে এসি নেই, হাত-পা ছড়িয়ে যাওয়ার স্বাচ্ছন্দ্য নেই। গাদাগাদি করে লোকে যায়। উচ্চবিত্তরা যাকে কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলেন, ক্যাটেল ক্লাস। কিন্তু ভোটে প্রভাব পড়তে পারে ভেবে শেষ পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়নি। তা সেই টানাটানির সংসারে দেড়শো কোটি তো কম নয়! তাও দিয়েছেন পীযূষ গোয়েল। নিঃসন্দেহে ভালো কাজ করেছেন। করোনা রুখতে সকলেই সাধ্যমতো পিএম কেয়ারে অর্থ সাহায্য করছেন। রেলও করেছে, তাতে আপত্তির কিছু নেই।

এর থেকে আরও একটা কথা প্রমাণিত হচ্ছে, রেল চাইলে তাদের দুরাবস্থার মধ্যেও মানবিক কাজে এরকম একশো-দেড়শো কোটি টাকা সাহায্য করতে পারে। তা হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাতে গিয়ে তারা এই রকম কিপটেমি করলো কেন? বিভিন্ন রাজ্যে আটকে পড়া ভিন রাজ্যের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ট্রেন চালাচ্ছে রেলমন্ত্রক। যাতে ৪০ দিন লকডাউনে থাকার পর শ্রমিকরা তাঁদের ঘরে ফিরতে পারেন। নাম শ্রমিক কল্যাণ ট্রেন। কিন্তু রীতিমতো নির্দেশিকা দিয়ে রেল জানিয়েছে, ট্রেন ছাড়ার আগে যে রাজ্যে ট্রেন যাচ্ছে, তাদের প্রতিনিধিদের হাতে টিকিট দেওয়া হবে। সেই টিকিট তারা যাত্রীদের দিয়ে তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে রেলের কাছে দিয়ে দেবেন। একেবারে ফেলো কড়ি মাখো তেলের ব্যবস্থা। বিনি পয়সার ভোজ নয়। টাকা দিয়েই ট্রেনে চড়তে হবে পরিযায়ী শ্রমিকদের। এমনকী, শ্রমিকদের খাবার ও জলও দিতে হবে রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের। রেল সেটাও দেবে না। তারা কেবল কষ্ট করে ট্রেন চালিয়ে শ্রমিক কল্যাণের দায়টা সারছে। পিএম কেয়ারের প্রতি তাঁদের যে কেয়ার দেখা যাচ্ছে, শ্রমিক কল্যাণে তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না।

রেল যদি নাও দিতে পারে, কেন্দ্রীয় সরকার দিতে পারতো? মাত্র তো ৭০ কোটি টাকার মামলা। তাতেই সব শ্রমিককে ট্রেনে করে ঘরে ফেরানো যেতো। সেটা না করার কারণ কী? করোনা সামলাতে এত টাকা খরচ হচ্ছে, প্রায়ই আমরা শুনছি, সরকার গরিবদের জন্য এক লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার সহয়াতা প্রকল্প রূপায়ণ করছে। কর্পোরেটের জন্য প্যাকেজের কথা ভাবা হচ্ছে। বিমান শিল্প, গাড়ি শিল্প সকলে প্যাকেজ চাইছে। সরকার বিবেচনা করছে। সেই তুলনায় ৭০ কোটি টাকা কী আর খুব বেশি পরিমাণ অর্থ? না কি, গরিব মানুষগুলিরকাছ থেকে টাকা না নিলে রেল মন্ত্রক দেউলিয়া হয়ে যেত? সরকারের ওপরে বিপুল পরিমাণ বোঝা চাপতো? অথচ, বিদেশ থেকে আটকে পড়া ছাত্রদের বিমানে নিয়ে আসা হয়েছে। সেটাও ঠিক কাজই করেছে সরকার। বিরোধীদের দাবি, তখন কিন্তু বিমান ভাড়া চাওয়া হয়নি। বিরোধীরা বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে, সরকার আসলে বড়লোকদের স্বার্থ দেখে। গরিবের কথা ভাবার সময় তাদের হয় না। ভোটের আগে তাদের অ্যাকাউন্টে কিছু অর্থ সাহায্য করা হয়। যেমন গত ভোটের আগে সব কৃষককে বছরে ছয় হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা করে প্রথম কিস্তির দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিলো।

রোববার সকালে দেশজুড়ে বিমান গর্জনের শব্দ শুনেছে গোটা দেশ। দেখেছে ভারতীয় বিমান বাহিনীর জেটগুলি কী সুন্দরভাবে ত্রিভূজ আকৃতিতে উড়ে গিয়েছে শহর গ্রামের ওপর দিয়ে। হেলিকপ্টারগুলি ফুল ছড়িয়ে দিয়েছে হাসপাতালগুলির ওপর। নীচে  চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মীরা হাততালি দিচ্ছেন, তাঁদের ওপর ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে। খুব সুন্দর প্রতীকী দৃশ্য। ভিডিও সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়েছে। করোনায় চিকিৎসা ও চিকিৎসাকর্মীরা যে সেবা দিচ্ছেন, তাকে এইভাবে স্যালুট জানিয়েছে বিমান বাহিনী। নৌবাহিনীও তাদের মতো করে সেলাম জানিয়েছে চিকিৎসকদের। নিঃসন্দেহে এই স্যালুট চিকিৎসকদের প্রাপ্য। তাঁদের জন্যই হাজার হাজার করোনা রোগী বেঁচে ফিরছেন। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, যাকে বলা হয় আসমুদ্রহিমাচল-- এই ভাবে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের অভিবাদন জানাতে সরকারের বিপুল খরচ হয়েছে। নিন্দুকেরা বলেন, খরচটা সাড়ে ছয়শ কোটির মতো। তার তুলনায় তো ৭০ কোটি অনেক কম! এই টাকাটাও খরচ করা গেলো না? না হয় আমলারা কিছুদিন গাড়িতে কম চড়তেন! না হয়, সরকারি আতিথ্যের জন্য খরচ কম করে দেওয়া হতো! দিল্লিতে বিভিন্ন মন্ত্রকের কর্মীরা, মন্ত্রীর অফিসের কর্মীরা শনি ও রোববার অফিস করলে টিফিনের খরচও পান। গাড়িও পান। সেটাও কিছুদিন বন্ধ রাখা যেতো। অথবা একটা নির্বাচনে না হয় ৭০ কোটি টাকা কম খরচ করতো ক্ষমতাসীন দল!

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

সরকারের কথার মধ্যে হঠাৎ রাজনৈতিক দলকে ঢোকানোয় আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু মুশকিল হলো, রাজনৈতিক জমি ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া কংগ্রেস পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ফেলেছে। রোববার কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী সব প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিদের নির্দেশ দিয়েছেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের দেশে ফেরার টাকা যেন তাঁরা দিয়ে দেন।  তারপরই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে কর্ণাটক প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি রাজ্য সরকারকে পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফেরার খরচ হিসাবে এক কোটি টাকার চেক কেটে দিয়েছেন। তারপর বলেছেন, আর কত টাকা লেগেছে জানাতে, সেটাও কংগ্রেস দিয়ে দেবে। বাকি রাজ্যেও প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি তৎপর হয়ে টাকা জোগাড় করে রাজ্য সরকারকে দেওয়ার উদ্যোগ শুরু করেছে। একসময় কংগ্রসের স্লোগান ছিলো, 'কংগ্রেস কা হাত, আম আদমি কা সাথ'। সাধারণ লোক তা বিশ্বাস করেছিল। পরপর দুই বার সরকার গঠন করেছিলেন মনমোহন সিং। কংগ্রেস আবার সেই আম আদমির বিশ্বাস ফিরে পেতে চাইছে, পরিযায়ী শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিটের টাকা মিটিয়ে দিয়ে। মনে রাখতে হবে, এই শ্রমিকরা ৪০ দিন ধরে লকডাউনের মধ্যে ছিলেন। তাঁদের পুঁজি শেষ। মরিয়া হয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে অভুক্ত শ্রমিকরা মারা গিয়েছেন। বাড়ি থেকে কারও ১৪, কারও ৪০ কিলোমিটার দূরে যাত্রা থেমে গিয়েছে। কেউ বা বাড়ি পৌঁছে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা গিয়েছেন।  সেই অভাবী শ্রমিকদের জন্য এই কটা টাকা খরচ করতে পারলো না সরকার?

উল্টে বিজেপি শাসিত সুরাতে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফেরার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস ব্যবাহার করে সেই বিক্ষোভ থামায় পুলিশ। এই বার্তাটাও খুব ভালোভাবে যায়নি সাধারণ মানুষের কাছে। বিশেষ করে বিহার ও উত্তর প্রদেশে। এই দুই রাজ্যের শ্রমিকই সুরাতে বেশি। পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকরাও আছেন। পশ্চিমবঙ্গে আবার নতুন সমস্যা। কংগ্রেস নেতা রেলমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর জানিয়েছেন, রেল কেরালা থেকে রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরার জন্য ট্রেন দিতে চেয়েছিলো। রাজ্য সরকার সাতদিন সময় চেয়েছে।

ফলে এই গরিব মানুষদের নিয়ে বিতর্কের পর বিতর্ক। করোনার বাজারে কাজ নেই। কবে কাজ পাওয়া যাবে তা কেউ জানে না। এই অবস্থায় ঘরে ফেরা নিয়েও এত সমস্যা। এত বিতর্ক। এত কলরব। কেন? তাঁরা গরিব মানুষ বলে? লোকসভা ভোট এখনও বেশ কয়েক বছর বাকি বলে? না কি, এই গরিব মানুষরা ভোটের সময় ছাড়া সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে না বলে?