1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা

১৭ অক্টোবর ২০২৪

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, বোন শেখ রেহানা এবং সাবেক সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে৷

https://p.dw.com/p/4lvD3
Bangladesch Internationale Strafgerichtshof (ICT)  Haftbefehl gegen Ex-Premierministerin Sheik Hasina
ছবি: Privat

একটি আবেদনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এবং বাকি ৪৫ জনের বিরুদ্ধে অপর আরেকটি আবেদনের পরপ্রেক্ষিতে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে৷ শেখ হাসিনাহ ওই ৪৬ জনকে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷

আজ বৃহস্পতিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন৷ অপর দুই সদস্য হলেন: বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী৷ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম৷

অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই অপরাধগুলো বিস্তৃত মাত্রায়, সারা বাংলাদেশজুড়ে সংঘটিত হয়েছে৷ এই অপরাধের আসামি যারা, তারা অসম্ভব রকমের প্রভাবশালী, তাদের গ্রেপ্তার করা না হলে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করাটা অসম্ভব কঠিন৷ তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ, এমনকি শহীদ পরিবারের সদস্যরা কথা বলতে সাহসী হচ্ছেন না৷''

অভিযোগে ঘটনার তারিখ হিসেবে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় উল্লেখ করা হয়েছে৷ এছাড়া উল্লেখিত সময়ে আহত হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে নিহতরাও এর আওতায় থাকবেন৷ ঘটনার স্থান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে গোটা বাংলাদেশকে৷

অপরাধের ধরনে বলা হয়েছে, এক থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্যান্য আসামিরা দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাদের হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করেছে৷

গণহত্যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পর এখন তাদের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হবে বলে জানান তাজুল ইসলাম৷ শেখ হাসিনাসহ বিদেশে পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নেয়া যাবে বলেও জানান তিনি৷

‘‘গণহত্যা প্রমাণে কোনো অসুবিধা হবে না’’

মামলায় আসামিদের মধ্যে আরো আছেন: আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দিপু মনি, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক৷

এছাড়াও আছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, ডিবির সাবেক প্রধান হারুন উর রশিদ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, পুলিশের অতিরিক্ত উপ মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল ডিআইজি) প্রলয় কুমার জোয়ারদার, সাবেক ডিমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, র‌্যাবের সাবেক ডিজি হারুন অর রশিদ, সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান৷

আরো আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ।

তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা৷ প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা মামলাটি করেছি৷ তবে তদন্ত সংস্থার কাছে আরো আবেদন আছে৷''

তিনি জানান, ‘‘এই মামলার কিছু আসামি ইতিমধ্যে অন্য মামলায় গ্রেপ্তার আছেন৷ পুলিশ সেটা যাচাই করবে৷ আদালত এখন গ্রেপ্তার সংক্রান্ত বিষয়ে পুলিশকে দায়িত্ব দিয়েছে, তারাই এটা এখন দেখবে৷ যারা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন তাদের ব্যাপারেও আদালতকে পুলিশ জানাবে৷''

শেখ হাসিনার অবস্থান নিয়ে নিশ্চিত নয় সরকার

এদিকে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ‘‘শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য এখনো আসেনি৷ তবে আনঅফিসিয়ালি জানা গেছে তিনি দিল্লিতেই রয়েছেন৷''

এক প্রশ্নের জবাবে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালানোর নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি মেগা প্রজেক্টে মেগা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে৷ এসব ঘটনায় বিচারের জন্য তাকে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা চলছে৷ শেখ হাসিনাকে ফেরাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷''

এছাড়া আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে আরো যে ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, তারা কোথায় আছে সেটা জানতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি৷

ভারতেই আছেন শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতেই আছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল৷ বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন৷

রণধীর জয়সোয়াল বলেন বলেন, নিরাপত্তার কারণে খুব অল্প সময়ের নোটিশে শেখ হাসিনা ভারতে চলে এসেছিলেন। এখনও আছেন।

মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনাল

বাংলাদেশের সংবিধানে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারে বিষয়টি সংযুক্ত হয় ১৯৭৩ সালে৷ স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ৷ পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়৷

এই ট্রাইব্যুনালে ইতিমধ্যে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অনেকের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর হয়েছে৷ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আরও কয়েকজনের বিচার ট্রাইব্যুনালে চলছিল৷

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান অবসরে যান৷ আর এক সদস্যকে হাইকোর্টে ফিরিয়ে নেওয়া হয়৷ অপর সদস্য অব্যাহতি নিয়েছেন৷ এছাড়া আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রসিকিউটরেরা পদত্যাগ করেন৷ ১৫ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালে যোগ দেন তিন সদস্যের বিচারক প্যানেল৷ এর আগেই চিফ প্রসিকিউটর এবং তদন্ত সংস্থার জনবল নিয়োগ দেয়া হয়৷

ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কাছে এরইমধ্যে ৬০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে৷ নিয়ম হলো অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত সংস্থা তদন্ত করে অভিযোগের প্রমাণ পেলে প্রসিকিউশনের কাছে মামলার জন্য জমা দেবে৷ প্রসিকিউশন ট্রাইব্যুনালে মামলা করবে৷ চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘শেখ হাসিনা এবং অন্য ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েই এবারের মামলা শুরু হলো৷''

‘‘প্রশ্ন হলো এটাকে গণহত্যা প্রমাণ করা যাবে কিনা’’

এই ট্রাইব্যুনালে  বিচার কতটা সম্ভব?

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ এস এম শাহজাহান মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত মতিউর রহমান নিজামী ও মাওলানা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীসহ আরো কয়েকজনের আইনজীবী  হিসেবে  কাজ করেন উচ্চ আদালতে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জুলাই-আগস্টের ঘটনা যদি গণহত্যা হয় তাহলে এই ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্ভব৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো এটাকে গণহত্যা প্রমাণ করা যাবে কিনা৷ কারণ, গণহত্যা হলো কোনো গোষ্ঠী, জাতি, সম্প্রদায়কে নির্মূল করা৷ ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের নিধনে নেমেছিলো৷ আমরা ন্যুরেমবুর্গ, রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল দেখলেও বিষয়গুলো বুঝতে পারব৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘এবার ছিলো সরকার পতনের আন্দোলন৷ সেখানে হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে৷ এটার বিচার হতে হবে৷ কিন্তু সেটা প্রচলিত ফৌজদারি আইনেও সম্ভব৷''

তবে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এটা গণহত্যা প্রমাণে কোনো অসুবিধা হবে না৷ আর এই ট্রাইব্যুনালেই বিচার সম্ভব হবে৷ তারপরও আইনে কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে৷''

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুকও মনে করেন গণহত্যা প্রমাণে কোনো সমস্যা হবে না৷ তার যুক্তি, ‘‘এখানে শেখ হাসিনা সরকার তার বিরোধীদের নিধনে সব শক্তি প্রয়োগ করেছে৷ এটা ছিলো বিরোধীদের নিধন প্রক্রিয়া৷ এটা গণহত্যা৷''

এদিকে, আইনে পরিবর্তন আনার কাজ করছে সরকার৷ সেখানে গণহত্যার অপরাধে সংগঠনকেও বিচারের আওতায় আনাসহ আট দফা পরিবর্তন করা হতে পারে৷ অ্যাডভোকেট এ এস এম শাহজাহান বলেন, ‘‘আইনে পরিবর্তন এনে সেই আইনে আগের অপরাধের বিচার করা যায় না৷ তবে প্রসিডিওরে পরিবর্তন আনা যায়৷ আর কমান্ড রেসপনসিবিলিটির বিষয়টিও প্রমাণ সাপেক্ষে৷ যেমন রাজাকারের কমান্ড রেসপনসিলিবিলিটি হলো রাজাকার কামান্ডারের৷''

অন্যদিকে ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন, ‘‘এখন যিনি চিফ প্রসিকিউটর তিনি এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সময় ডিফেন্স আইনজীবী (আসামি পক্ষের) ছিলেন৷ ফলে তার নিয়োগে আইনের কোনো লঙ্ঘন হয়েছে কি-না তা আমার জানা নেই৷''

তিনি বলেন,  ‘‘আগে আমি এই ট্রাইব্যুনালের অনেক সমালোচনা করেছি৷ বলেছি এটা আন্তর্জাতিক মানের নয়৷ এখানে বিদেশিদের ইনভলভড করা হয়নি৷ এখনো আমার সেই সমালোচনা আছে৷ সেই দিকটিও দেখতে হবে৷''

এ এস এম শাহজাহান বলেন, ‘‘এই বিচারে সরকার জাতিসংঘের সহায়তা চেয়েছে৷ তাদের একটি দল এসেছিলো৷ চিফ প্রসিকিউটর বলেছেন বিদেশি আইনজীবী নিয়ে করা যাবে৷ তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে এর কোনো প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে৷''