গণপরিবহণ মালিকদের কাছে সরকার অসহায়?
১৯ জানুয়ারি ২০২২তবে গণপরিবহনের জন্য আইন ভিন্ন। গণপরিবহনে ১৫ জানুয়ারি থেকে বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। তবে মালিকেরা যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই হয়েছে।
করোনা সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকায় সরকার ১১ দফা বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। গত ১০ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন আকারে এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ১৩ জানুয়ারি থেকে। তবে গণপরিবহনের জন্য আইন ভিন্ন। গণপরিবহনে ১৫ জানুয়ারি থেকে বিধিনিষেধ শুরু হয়েছে। তবে মালিকেরা যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই হয়েছে।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গণপরিবহন অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। এর জন্য যাত্রীদের কোন ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়নি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত মানতে অস্বীকৃতি জানান গণপরিবহন মালিকেরা। দুইদিন পর তারা জানিয়ে দেন, যত আসন তত যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলবে। পরে তাদের সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে সরকার। কোনো প্রজ্ঞাপন না হলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) মালিকদের চাওয়া অনুযায়ী চিঠি দিয়ে অনুমতি দিয়েছে। সরকারের ঘোষিত ১০ দফা বাস্তবায়ন শুরু হলেও শুধু গণপরিবহনের জন্য ভিন্ন নির্দেশনা। ফলে প্রশ্ন উঠেছে গণপরিবহন মালিকদের কাছে কী সরকার অসহায়?
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গণপরিবহন চলছে। মালিকেরা যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। তারা বলেছিল, সব আসনে যাত্রী নিয়ে তারা বাস চালাতে চান, সরকার তাদের অনুমতি দিয়েছে। তাদের আবেদনের বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছিলাম, মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। এরপর আমরা তাদের চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়ে দিয়েছি।”
এদিকে করোনা সংক্রমণ বেড়েই চলছে। বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে আক্রান্ত রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ৯ হাজার ৫০০ জন। শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ১১ শতাংশ। অথচ আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬ হাজার ৬০০ জন। ২০ শতাংশের কম।
পূর্ণ যাত্রী নিয়ে বাস চললেও ট্রেন চলছে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে। ট্রেনের ৫০ শতাংশ আসনের ২৫ শতাংশ টিকিট অনলাইনে এবং ২৫ শতাংশ টিকিট কাউন্টারে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে লঞ্চের বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে আগের মতোই যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে লঞ্চে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ঢাকা নদীবন্দরের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন বলেছেন, "সরকারি নির্দেশনা মেনে লঞ্চে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। তবে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে না। সব যাত্রীর স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থাৎ মাস্ক নিশ্চিত করে প্রতিটি লঞ্চ ছাড়া হচ্ছে।”
বাসে সব আসনে যাত্রী নেওয়ার নির্দেশনা সরকারের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিলেও সে সিদ্ধান্তও মানছেন না বাস মালিকেরা। বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একাধিক বাসে দাঁড়িয়ে যাত্রী নিতেও দেখা গেছে। বিহঙ্গ পরিবহনের চালক রফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানালেন, "আমরা তো আসনের বেশি যাত্রী নিতে চাই না। কিন্তু যাত্রীরা ঠেলাঠেলি করে উঠে পড়ছেন। আমরা কীভাবে তাদের নামিয়ে দেবো?” ওই বাসেই দাঁড়ানো যাত্রী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী তালেবুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অফিস খোলা রেখে এসব আইন করে লাভ কী? আমাদের সময়মত অফিসে না গেলে অ্যাবসেন্ট করে দেয়। ফলে স্বাস্থ্যবিধির চেয়েও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সঠিক সময়ে অফিসে পৌঁছানো।”
করোনা টিকার সনদ ছাড়া বাস চালাতে পারবেন না চালক ও শ্রমিকেরা সরকারি এমন সিদ্ধান্তও মানা হচ্ছে না। এসব ব্যাপারে পদক্ষেপ কী জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, "আমাদের মোবাইল কোর্ট কাজ করছে। যারা আইন মানছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে অনীহা কেন জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সবার নজর গণপরিবহনে। মনে হচ্ছে, গণপরিবহন থেকেই শুধু করোনা ছড়াচ্ছে। অথচ বাণিজ্য মেলা চলছে, হাট-বাজার, শপিং মনে হাজার হাজার মানুষ মাস্ক না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরা চাই সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম সবদিকেই নজর দিক। শুধু গণপরিবহনে তাকিয়ে না থেকে অন্যদিকেও আপনারা তাকান। আমরা সরকারি সিদ্ধান্ত মেনেই গাড়ি চালাচ্ছি। সবাই যে আইন মানছে তা নয়, যারা মানছে না মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের শাস্তির আওতায় আনছে বিআরটিএ।”
সরকারি বিধিনিষেধ কীভাবে বাস্তবায়ন করছে পুলিশ জানতে চাইলে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা শুধু মানুষকে সচেতন করতে পারি। সেই কাজটাই করছি। জেলা প্রশাসন কোন মোবাইল কোর্ট চালালে তাতে আমরা সহযোগিতা করি। আমাদের তো কাউকে শাস্তি দেওয়ার আইনগত অধিকার নেই। ফলে পুলিশের পক্ষে যেটা করা সম্ভব সেটাই আমরা করছি।”
সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে সামনে দিনে পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? জানতে চাইলে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকার যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিল, সেগুলো ভালো ছিল। মানা গেলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। কিন্তু কারও মধ্যেই বিধিনিষেধ মানার আগ্রহ নেই। ফলে সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে চলছে থাকলে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষে চিকিৎসা ব্যবস্থা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এখন বাণিজ্য মেলা চলছে, গণপরিবহন মালিকেরা কথা শুনছেন না, রেস্টুরেন্টে কোভিড সনদ নিয়ে যাওয়ার কথা, সেটাও কেউ মানছেন না। আমার মনে হয়, শুধু নির্দেশনা না দিয়ে, তাদের সঙ্গে বসা উচিৎ। তারা কোন পরামর্শ দিলে সেটা ভালো হলে মানতে দোষ কোথায়? তবে যেভাবেই হোক এগুলো মানতে হবে। আগের দিনের তুলনায় বুধবার প্রায় তিন হাজার আক্রান্ত বেড়ে গেছে। আগের দিন বেড়েছে দুই হাজার। এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে যাবে।”
২০২১ সালের ছবিঘর