1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণঅসন্তোষ, গণবিক্ষোভ

২১ আগস্ট ২০১৮

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলন গণঅসন্তোষের বড় উদাহরণ৷ তবে এর আগেও বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ নিয়ে গণ অসন্তোষের ঘটনা আছে৷ এসব গণঅসন্তোষের কারণ কী?

https://p.dw.com/p/33M5s
ছবি: Getty Images/AFP/M. uz Zaman

কানসাটের বিদ্যুৎ আন্দোলন এখনো বাংলাদেশের মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি৷ ‘কানসাট আন্দোলন' নামে পরিচিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওই আন্দোলন সারা দেশকে নাড়া দিয়েছিল৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুতের দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয় এবং এপ্রিল মাসে আন্দোলনের সফল সমাপ্তি হয়৷ ওই আন্দোলেনে জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ২০ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত এবং শতাধিক আহত হয়৷ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গোলাম রব্বানি৷ একই সময়ে ঢাকার শনির আখড়ায় বিদ্যুতের দাবিতে রাস্তায় নেমে সহিংস বিক্ষোভ করেন নগরবাসী৷ আর বিক্ষোভের মুখে তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্য সালাহউদিন আহমেদ পালিয়ে যান৷ এই দু'টি আন্দোলনের সময়ই বিএনপি ছিল শাসন ক্ষমতায়৷ বিদ্যুৎ নিয়ে আন্দোলন পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনেও প্রভাব ফেলে৷

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষের আন্দোলন এবং গণঅসন্তোষের মুখে৷ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ গণঅসন্তোষের আরেকটি বড় উদাহরণ, যা গড়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে৷ সেই দাবি পূরণ হয়েছে৷

বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় চলতি বছরের শুরুতে৷ কিন্তু তা চূড়ান্ত রূপ পায় মার্চ-এপ্রিলে৷ এই আন্দোলন ছাত্রদের হলেও নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ এতে সমর্থন জানিয়ছে৷ সরকার শেষ পর্যন্ত কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নিলেও সংস্কারকে কোটা বাতিলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷ আর তাতে নতুন জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে৷ শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদে গ্রেপ্তার নির্যাতন অব্যঅহত আছে৷

সর্বশেষ ২৯ জুলাই ঢাকায় দু'জন স্কুল শিক্ষার্থীর  বাস চাপায় নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা৷ আট দিনের এই আন্দোলন ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে৷ এই আন্দোলনের শেষ দুই দিনে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের সংঘাত-সংঘর্ষ হয়৷ সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়৷ আন্দোলনের জেরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন ছাত্রকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়৷ শুধু তাই নয়, আন্দোলন চলাকালে পুলিশের সঙ্গে থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা ছাত্রদের ওপর হামলা চালায় বলেও অভিযোগ আছে৷ এখানেও সরকার ছাত্রদের নিরাপদ সড়কের ৯ দফা মেনে নিয়েছে বলে জানিয়েছে৷

বাংলাদেশে কখনো কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত গণঅসন্তোষ বা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে, যার মধ্যে ৯০-এর অভ্যুত্থাণ অন্যতম৷ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিলে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পদত্যাগে বাধ্য হয়৷ আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থাণ তো ইতিহাস৷ এর ফলে তখনকার পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়৷

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে নিকট অতীতে বা সাম্প্রতিক সময়ে যে গণআন্দোলন এবং অসন্তোষের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে রাজনীতির কোনো যোগ নেই৷ এই গণঅন্তোষের ঘটনা ঘটেছে যে কোনো একটি শ্রেণির মাধ্যমে৷ তাঁদের যেসব দাবি ছিল, সেগুলো ন্যায্য হওয়ায় তাতে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল৷ এমনকি সরকারও ওইসব দাবি যৌক্তিক বলে স্বীকার করেছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মেনেও নিয়েছে৷ তবে এইসব আন্দোলন থেকে শেষ পর্যন্ত কোনো কানো রাজনৈতিক শক্তি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করায় তা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে বা প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা গেছে৷

বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনীতি এবং সরকারের ব্যর্থতার কারণেই এসব গণঅসন্তোষ বা গণরোষের সৃষ্টি হয়৷ কারণ, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে  নগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ জমতে থাকে৷ তারা ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হতে থাকে৷ আর কোনো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে তার চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়কের দাবি যৌক্তিক দাবি৷ আর বাংলাদেশের মানুষ সড়ক দুর্ঘটনা ও সড়কে বিশৃঙ্খলা নিয়ে ক্ষুব্ধ অনেক দিন ধরেই৷ এই ক্ষোভের চরম প্রকাশ ঘটেছে ২৯ জুলাই সড়ক দুর্ঘচনায় দু'জন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর৷ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এলেও তার সঙ্গে অভিভাবক এবং সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমেছেন৷ একই কথা প্রযোজ্য কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে৷ ২০০৬ সালে কানসাটের বিদ্যুৎ আন্দোলনকেও একইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়৷

বিশ্লেষকদের মতে, নাগরিকরা তাঁদের নানা চাওয়া-পাওয়া এবং না পাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ হন৷ তাঁরা এটা প্রকাশও করতে চান৷ এই প্রকাশের পথ রুদ্ধ হওয়াও গণঅন্তোষের আরেকটি কারণ৷ রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ হচ্ছে মানুষের ন্যায্য দাবি এবং চাওয়া-পাওয়া নিয়ে আন্দোলন করা৷ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা৷ আর সরকারের উচিত নগারিকদের যৌক্তিক এবং ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নেয়া বা পুরণ করা৷ দাবি তোলার আগেই সরকারকে অনেক সময় তা পুরণ করতে হয়৷ কিন্তু এই সাধারণ যৌক্তিক বিষয়গুলো যখন না হয়, তখন নাগরিকদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের হঠাৎ করেই বহিঃপ্রকাশ ঘটে কোনো একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে৷ সাধারণ চোখেএটাকে হঠাৎ মনে হলেও আসলে এগুলো হঠাৎ কোনো ঘটনা নয়৷ বাংলাদেশে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে মাঠে নামা প্রমাণ করে সড়কে হত্যা এবং বিশৃঙ্খলা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ কোন পর্যায়ে গিয়েছিল৷

ড. তারেক শামসুর রহমান

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের  সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের এইসব আন্দোলন এবং অসন্তোষের পিছনে যৌক্তিক কারণ আছে৷ আর সরকারও তা স্বীকার করে৷ কোটা সংস্কার বা স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে জনসমর্থন আছে৷ তাছাড়া এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়৷ কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু খারাপ উপাদান ঢুকে যাওয়ায় পরের দিকে হয়তো আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা ছিল৷''

তিনি বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষ যখন তাঁদের সমস্যার কোনো প্রতিকার না পায়, তখন তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের ক্ষোভ জমতে থাকে৷ কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ সরকারের উচিত সবসময় এসব যৌক্তিক আন্দোলনকে ইতিবাচকভাবে নেয়া এবং একটি কমিশন গঠন করে যৌক্তিক দাবিগুলোকে মেনে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকারের উচিত নাগরিকরা কী চায়, নাগরিকদের কোথায় পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আছে, সেগুলো চিহ্নিত করে আগে থেকেই সেসব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ নেয়া৷ তাহলে হয়তো এসব নগারিক ক্ষোভ, বিক্ষোভ এড়ানো সম্ভব৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শান্তনু মজুমদার এই সামাজিক ক্ষোভ-বিক্ষোভকে ব্যাখ্যা করেন আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের ধারাকে আশ্রয় করে৷ তাঁর মতে, ‘‘রাজনৈতিক দল এবং সরকারকে দাবি জানাতে বা দাবি পূরণে এখন মানুষ নিজেরাই তৃতীয় শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিদেশেও হচ্ছে৷ ওয়াল স্ট্রিট মুভমমেন্ট তার বড় উদাহরন৷ আর এইসব আন্দোলনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষকে সংগঠিত করার বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে৷''

ড. শান্তনু মজুমদার

তিনি বলেন, ‘‘সরকার ও রাজনৈকি দলগুলোর প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতার কারণেই মানুষ মাঠে নামছে৷ আর তাঁরা মাঠে নামছে বিভিন্ন ইস্যুতে৷ এটা কিন্তু সরকার পতনের কোনো আন্দোলন নয়৷ এটা সরকারকে দাবি আদায়ে বাধ্য করা অথবা চাপ সৃষ্টি করার জন্য করা হয়৷ সরকারের উচিত এটা বোঝা এবং সেভাবে কাজ করা৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারছে না৷ তাদের কাছে এটা নতুন এবং তারা এর গতি-প্রকৃতিও ধরতে পারছে না৷ ফলে কেউ এই আন্দোলনকে ভয় পাচ্ছে৷ আবার কেউ সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে৷  কিন্তু কোনো পক্ষই ঠিকভাবে এইসব আন্দোলনকে পাঠ করতে পারছে না৷ এটা বুঝতে হবে৷ এবং মত প্রকাশের নতুন এই ধারা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে৷''