1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

খুলছে বন্ধ বাগান, আশঙ্কা কাটছে না

১৪ জুলাই ২০২২

পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং চা ভুবন-বিখ্যাত। অপরূপ চা বাগানের ভিতরে ঢুকলে অন্ধকারের কাহিনি সামনে আসে। ডিডাব্লিউ-র বিশেষ রিপোর্ট।

https://p.dw.com/p/4E5yT
দার্জিলিং চা বাগানের অন্দরে শুধু অন্ধকারের কাহিনি।
দার্জিলিং চা বাগানের অন্দরে শুধু অন্ধকারের কাহিনি। ছবি: Satyajit Shaw/DW

সম্প্রতি দার্জিলিংয়ে গিয়ে চা-পর্যটনের কথা বলে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যা শুনে মাথায় হাত চা বাগানের লাখ লাখ শ্রমিকের। প্রকাশ্যে তাদের অনেকে এর বিরোধিতা শুরু করেছেন। বিরোধিতা করেছেন চা বাগান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরাও।

দার্জিলিং পাহাড় থেকে পাহাড়ের পাদদেশে তরাই এবং ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ জমি চা বাগানের জন্য বিখ্যাত। খাতায় কলমে প্রায় ২৮৩টি চা বাগান আছে এই অঞ্চলে। বাস্তব সংখ্যা আরো বেশি। পাহাড়ের চেয়ে ডুয়ার্স-তরাইয়ে চা বাগানের সংখ্যা বেশি। চা বাগানের আয়তনও বেশি। দার্জিলিং পাহাড়ের চা বিশ্বখ্যাত হলেও পরিমাণে অনেক বেশি চা তৈরি হয় ডুয়ার্স এবং তরাইয়ে। দিগন্ত বিস্তৃত সেই চা বাগান দৃশ্যত অপূর্ব হলেও সাম্প্রতিককালে এই শিল্প চরম সংকটের মুখোমুখি। গত এক দশকে একের পর এক বাগান বন্ধ হয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ চরমে পৌঁছেছে। চা বাগানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।

সংকটের কাহিনি

চা মালিকদের একটি বড় অংশের দাবি, চা বিক্রি করে যথেষ্ট লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না তারা। বিরাট বিরাট চা বাগান রক্ষাণাবেক্ষণ করে, শ্রমিকদের পাওনা মিটিয়ে চা বাগান চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িযেছে। সে কারণেই গত এক দশকে একের পর এক বাগান বন্ধ হয়েছে বলে তাদের দাবি। বছর দশেক আগে বাগান বন্ধ করে দেওয়া এক মালিক নাম প্রকাশ করা যাবে না এই শর্তে ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''সরকার কেবলমাত্র শ্রমিকের স্বার্থ দেখে। মালিকদের সমস্যাগুলি বোঝার চেষ্টা করে না। সে কারণেই চা বাগানের সমস্যার কোনো সমাধানসূত্র মেলে না।'' বস্তুত, চা বাগান থেকে যে লাভ কমে গেছে, তা মেনে নিয়েছেন বিখ্যাত বাগান গিদ্দাপাহাড়ের মালিকও। ১৮৮০-র দশকে তৈরি এই বাগানের চতুর্থ প্রজন্মের মালিক শুধাংশু সাউ ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''চা থেকে আগের মতো আর লাভ পাওয়া যায় না। করোনাকালে বাজারের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বহু বছর সময় লাগবে।'' শুধাংশুর বক্তব্য, চা বাগানের সমস্যার নানা পরত আছে। বিষয়গুলি জটিল। সকলের স্বার্থের কথা না ভাবলে বাগান বাঁচানো কঠিন।

মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের জের

এই পরিস্থিতির মধ্যেই চা বাগান নিয়ে মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চা বাগানের লাভ বাড়ানোর জন্য চা পর্যটনের কথা বলেছেন তিনি। চা বাগানগুলিতে হোম স্টে তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। বস্তুত, কিছুদিন আগেও চা বাগানের সমস্যায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকারের তরফে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিলেন তিনি। যার জেরে এখন ২৩২ টাকা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের চা শ্রমিকরা।

দার্জিলিংয়ের কোনো কোনো চা বাগানে ইতিমধ্যেই হোম স্টে তৈরি হয়েছে। পর্যটকরা সেখানে বেড়াতেও যাচ্ছেন। কিন্তু আদৌ কি এই ভাবে চা শিল্পকে বাঁচানো যাবে? এ প্রশ্ন তুলছেন খোদ বাগানের শ্রমিকরা। তাদের বক্তব্য, চা গাছ কেটে সেখানে হোটেল তৈরি করে চা বাগানকে বাঁচানো যাবে না। এতে বাগানের ক্ষতি আরো বাড়বে। দীর্ঘদিন ধরে চা বাগানে ট্রেড ইউনিযন আন্দোলন করেন বামপন্থী রাজনীতিক সমন পাঠক। শিলিগুড়িতে সিপিএমের পার্টি অফিসে বসে ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ''চা শ্রমিকদের সমস্যা না মিটলে চা বাগান বাঁচানো কঠিন। সরকার এবং মালিকপক্ষ ওই বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। বাগানে পর্যটন গড়ে তুলে সাময়িক সমস্যার সমধান হতে পারে কিন্তু চা বাগানের ভবিষ্যত বদলানো যাবে না।''

চা শ্রমিকদের বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ তা মানেন পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা অলোক চক্রবর্তী। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে চা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ''চা বাগানের উন্নতির বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মাথা ঘামাচ্ছেন। সে কারণেই দৈনিক মজুরি বাড়ানো হয়েছে। বন্ধ চা বাগানগুলি খোলার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। আগামী এক মাসের মধ্যে প্রায় সবকটি বাগান নতুন করে খুলে যাবে।'' বস্তুত, গত কয়েকমাসে অধিকাংশ বন্ধ বাগানই নতুন করে খুলেছে। একাধিক বাগানে নতুন মালিক এসেছে।

শ্রমিকদের বক্তব্য

পাঁচবছর, দশবছর ধরে বন্ধ থাকার পর নতুন করে বাগান খুলতে শুরু করেছে। শিলিগুড়ি শহর থেকে এক ঘণ্টার দূরত্বে তেমনই এক চা বাগান গঙ্গারাম। ২০১২  সালে বাগান বন্ধ হয়ে গেছিল। অতি সম্প্রতি নতুন মালিক বাগানে আসতে শুরু করেছে। বাগানের সবকটি সেকশনে কাজ শুরু না হলেও ধীরে ধীরে বাগান নতুন করে সেজে উঠছে। গঙ্গারাম যখন বন্ধ হয়ে গেছিল, বাগানের শ্রমিকরা তখনো নিজেদের মতো করে বাগান চালিয়েছিলেন। পাতা তুলে কনট্রাক্টরের মাধ্যমে তারা অন্য কারখানায় পাতা পাঠাচ্ছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে তারা লড়াই চালিয়ে গেছেন। নতুন করে বাগান খোলার খবরে তারা খুশি। কিন্তু একইসঙ্গে তাদের প্রশ্ন, পুরনো পাওনাগুলি মিলবে তো?

চা বাগানের হিসেব

চা বাগানের মজুরি বরাবরই কম। দেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক কম দৈনিক মজুরি পান চা শ্রমিকরা। মালিকদের বক্তব্য, দৈনিক মজুরির পাশাপাশি একাধিক সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয় চা শ্রমিকদের। সেই বিষয়টিকেও হিসেবের মধ্যে আনতে হবে। বস্তুত ব্রিটিশদের তৈরি চা বাগানের মূল কাঠামো এখনো একই আছে। কর্মবিভাজন থেকে শুরু করে শ্রমিকদের জন্য ব্যবস্থা, সবই ঔপনিবেশিক আমলের নিয়মে চলে। দৈনিক মজুরির পাশাপাশি চা শ্রমিকদের বাসস্থান দেওয়া হয়, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, বাড়ি সংস্কারের টাকা, জ্বালানি-সহ আরো বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার বিষয়টিও চা মালিকদের দেখার কথা। একসময় শ্রমিকদের রেশনও দেওয়া হতো। এখন সরকার বিনামূল্যে রেশন দেয় বলে মালিকরা তা দেয়া বন্ধ করেছেন।

শ্রমিকদের বক্তব্য, খাতায় কলমে এইসব সুযোগ সুবিধার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর অধিকাংশই মিলছে না। সুযোগ সুবিধা দেওযার নামে দুর্নীতি হচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন কেউ কেউ। গঙ্গারাম চা বাগানের কর্মী দুর্গা ওরাও ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''পরিস্থিতি এমনই যে স্বামীর চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারিনি। চা বাগান কোনোরকম সাহায্য করেনি। ইউনিয়নের নেতাদেরও দেখতে পাইনি। ওরা শুধু ভোটের সময় আসে।'' চা বাগানের ধারে ছোট্ট দোকান বানিয়েছেন দুর্গা। দোকানের পাশে প্রায় সবকটি রাজনৈতিক দলের পতাকা। সে দিকে তাকিয়ে রাজনীতিবিদদের প্রতি নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিলেন দুর্গা।

ডুযার্স-তরাইয়ের অধিকাংশ চা বাগানের কর্মীর বক্তব্যের সঙ্গে দুর্গার কথা মিলে যায়। আলিপুরদুযারে ভুটান সীমান্তে ছবির মতো সুন্দর চা বাগান তুরতুরি। বছরদুযেক আগে মালিক বদলেছে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্যে চাপা ঘোরেনি। শ্রমিকেরই মজুরি থেকে কেটে নেওয়া গ্র্যাচুইটির টাকা দিচ্ছে না মালিক। ওই টাকাই অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। তুরতুরির চা কোয়ার্টর্সে কেবলই হাহাকার। সম্প্রতি একাধিক অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক মারা গেছেন। কিন্তু এখনো তাদের গ্র্যাচুইটির টাকা ঢোকেনি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাও বছরের পর বছর ধরে আটকে আছে অনেকের। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হচ্ছে অনেকের। ঘরের চাল ফুটো, বাড়ি পাকা হয়নি, ছেলে মেয়েকে পড়ানো যাচ্ছে না-- এমন ঘটনা চা বাগানের ঘরে ঘরে।

সামসিং চা বাগানের অনিল প্রধান বলছিলেন, ''মালিক বদলালেও চা শ্রমিকদের কোনো সুবিধা হচ্ছে না। পুরনো বাগান নতুন মালিক কিনছেন ঠিকই কিন্তু পুরনো মালিকের দায় তিনি নিচ্ছেন না। কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, শর্ত চাপিয়ে দেওযা হচ্ছে। ফলে শেষপর্যন্ত চা শ্রমিক গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাচ্ছে। কোনো শ্রমিক পরবরতী প্রজন্মকে বাগানে পাঠাতে চান না।''

চা বাগান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আইআইটি-র গবেষক অনির্বাণ নন্দী। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''ঔপনিবেশিক গঠন থেকে চা বাগান বেরিয়ে আসতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে বাগান বাঁচানো অসম্ভব। চা শ্রমিকদের উন্নতি করতেই হবে। নইলে পরবর্তী প্রজন্মকে পাওয়া যাবে না। আর শ্রমিক ছাড়া চা বাগান চলবে না।'' অনির্বাণ জানিয়েছেন, গত কযেকবছরে বাগানে নারীপাচারের ঘটনা ঘটেছে। নাবালক ছেলেমেয়েদের লেবারের কাজে পাঠিয়ে দিয়েছেন বহু চা শ্রমিক। চা শ্রমিকদের সার্বিক দুর্দশা দৃশ্যত প্রকট।

চা বাগানের সমস্যা একটা নয়, অনেক। আবহাওয়াও সমস্যা তৈরি করছে। আগে যে পরিমাণ চা পাতা পাওয়া যেত, এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না। নতুন মালিকরা বাগানে বিনিয়োগ করে চটজলদি লাভের কথা ভাবছেন। শ্রমিকদের উপর চাপ বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে এক ভযাবহ পরিস্থিতি। এখান থেকে উত্তরণ হবে কীভাবে, তা কেবল অদৃষ্টই জানেন।