বেসরকারি হাসপাতাল নিয়ে বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গে
১৫ জুন ২০১৭পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ সেই চিরন্তন প্রশ্নটা আবার উঠছে– চিকিৎসকদের রোগীর প্রতি কতটা দায়বদ্ধ? স্বাস্থ্য পরিষেবা কি শুধু মুনাফার লক্ষ্যে পরিচালিত হবে, নাকি তার সামাজিক মূল্যবোধ থাকা উচিত?
সম্প্রতি একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল জনরোষের মুখে পড়েছে৷ কোথাও হাসপাতাল ভাঙচুর হয়েছে, কোথাও আক্রান্ত হয়েছেন চিকিৎসক বা হাসপাতাল কর্মী৷ এসবের প্রতিষেধক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে নতুন বিল পাশ করিয়েছে, সেটাই বা কতটা কাজে আসবে?
পশ্চিমবঙ্গে দু' হাজারের বেশি বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে৷ এর মধ্যে মুষ্টিমেয় বড় মাপের কর্পোরেট হাসপাতাল, আর বাকিটা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নার্সিংহোম ও ক্লিনিক৷ সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা নামমাত্র খরচে দেওয়া হয় বলে সেখানে ভিড় লেগেই থাকে৷ প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য দীর্ঘ সময় ব্যয় করতে হয়৷ যাঁরা কিছুটা অবস্থাপন্ন, তাঁরা বাড়তি টাকা খরচ করে বেসরকারি হাসপাতালে ছোটেন৷ জনমানসে এমন ধারণা প্রবল যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি টাকা দিতে হলেও সেখানে পরিচ্ছন্নতা বেশি, রোগীদের প্রতি বেশি খেয়ালও রাখা হয়৷ বিভিন্ন রাজ্য ও প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন কত মানুষ কলকাতায় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসেন৷ দীর্ঘদিন ধরেই এই হাসপাতালগুলির বিরুদ্ধে মূলত একটি অভিযোগই ওঠে, সেটি হলো আর্থিক অস্বচ্ছতা৷ অর্থাৎ, এই হাসপাতালে ভুয়ো বিল তৈরি করা হয়৷ রোগীদের পরিবারের অভিযোগ, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও রক্তপরীক্ষার খরচ বিলে জুড়ে দেওয়া হয়৷ যে পরীক্ষা করানোর দরকার ছিল না, সেগুলি করানো হয়, যে ওষুধ দেওয়া হয়নি, তারও টাকা আদায় করা হয়৷ এর সঙ্গে চিকিৎসকদের উদাসীনতার অভিযোগ তো রয়েইছে৷
সাম্প্রতিক জনরোষের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন৷ তাদের রীতিমতো চড়াসুরে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন৷ বলেছেন, জনগণের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে ব্যবসা চালানো যাবে না৷ চিকিৎসা পরিষেবাকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে পরিচালিত করতে হবে৷ শুধু কথায় সীমাবদ্ধ না থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘ক্লিনিক্যাল এস্টাবলিশমেন্ট বিল' পাশ করিয়েছে৷ এই বিলের মাধ্যমে রোগীর পরিবারের অভাব অভিযোগ খতিয়ে দেখার পরিসর বেড়েছে বলে দাবি শাসকদলের৷ তৈরি হয়েছে রেগুলেটরি কমিশন৷ এই কমিশন বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধ ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখবে৷
মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা৷ সিপিএম নেতা ও বিশিষ্ট চিকিৎসক ফুয়াদ হালিমের মতে, মুখ্যমন্ত্রীর চড়া সুরে সমস্যার সমাধান হবে না৷ তাঁর মতে, ‘‘নতুন আইন কার্যকর করার স্পষ্ট রূপরেখা তৈরি হয়নি৷ ২০১০ এর আইনে যে ট্রাইব্যুনালের কথা বলা ছিল, তা এই রেগুলেটরি অথরিটির থেকে বেশি কার্যকরী৷ ট্রাইব্যুনালে সর্বক্ষণের সদস্যরা ছিলেন, এই কমিশনের সদস্যরা পার্ট টাইম ভিত্তিতে কাজ করবেন৷'' ডা. হালিমের দাবি, ‘‘দু' হাজারের বেশি বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত অভিযোগ সামাল দেওয়ার জন্য এই ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়৷''
এ থেকেই একটা প্রশ্ন উঠে আসে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা চিকিৎসকের উপর এমন কড়া নজরদারির প্রয়োজন হচ্ছে কেন? তাহলে কি তাঁদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সারবত্তা রয়েছে? কলকাতার শীর্যস্থানীয় বেসরকারি হাসপাতাল সিএমআরআই-এ কয়েকদিন আগেই রোগী অসন্তোষের জেরে ভাঙচুর চলেছিল৷ এই হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ডাক্তার সন্দীপ কুমার ভট্টাচার্য রাজ্যের বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ উড়িয়ে দেননি৷ তিনি স্বীকার করেছেন, অনেক হাসপাতালেই ভুয়া বিল করা হয়৷ সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা রয়েছে, এ কথা বলার উপায় নেই৷ এমনকি প্রয়োজনের বেশি শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করানো হয় বেসরকারি হাসপাতালে৷ ডা. সন্দীপ মেনে নেন, ‘‘এই বাড়তি খরচ রোগীর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়৷ তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটছে, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই৷''
কিন্তু তিনি চিকিৎসকদের উপর নজরদারি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ তাঁর মতে, ‘‘বাড়তি ওষুধ দেওয়া হলো কিনা বা অপ্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষা করানো হলো কিনা, সেটা একমাত্র একজন চিকিৎসকই বলতে পারবেন৷ অন্য কারও কথার এখানে মূল্য নেই৷'' এ কথা বললেও ডা. সন্দীপের স্বীকারোক্তি, ‘চিকিৎসকদের মধ্যেও সততার অভাব রয়েছে৷ যিনি মাইক্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ তিনি কার্ডিওলজি প্র্যাকটিস করছেন৷ তবে উল্টোটাও সত্য, প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রে শুধু বিশেষজ্ঞরাই চিকিৎসা করলে অনেক রোগীকে দেখা সম্ভবই হত না৷'' আর মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসা ক্ষেত্রে সব রোগের জন্য যে প্যাকেজের কথা বলেছেন, তা উড়িয়ে দেন ডাক্তার ভট্টাচার্য৷ তাঁর মতে, ট্রান্সপ্লান্ট বা বাইপাসের মতো ক্ষেত্রেই প্যাকেজ সম্ভব৷ তা-ও জটিলতা এলে প্যাকেজ মেনে চিকিৎসা হতে পারে না৷ ম্যালেরিয়া, জ্বর এসবের মতো রোগের ক্ষেত্রে প্যাকেজ দেওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়৷
এই আলোচনাতেই পরিষ্কার, শুধু নজরদারির দাওয়াই দিয়ে জনরোষের নিবৃত্তি করা সম্ভব নয়৷ এ ক্ষেত্রে চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা সবচেয়ে বড় বিষয়৷ রোগের প্যাকেজ তৈরি বা হাসপাতালে নজরদারি নয়, ডাক্তার এবং রোগীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভরসাই স্বাস্থ্য পরিষেবায় সবচেয়ে প্রয়োজন৷ বিশ্বায়নের পরিমণ্ডলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বেশি মুনাফা-তাড়িত৷ হাসপাতালের মালিকরা চিকিৎসা পরিষেবাকেও আর পাঁচটা ব্যবসার মতোই দেখছে৷ তাই আরও বেশি মুনাফার লোভ রোগীর সঙ্গে হাসপাতাল ও চিকিৎসকের সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করছে৷
পশ্চিমবঙ্গ থেকে দলে দলে রোগী দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসা করাতে যান৷ সেখানে কর্পোরেট ও বেসরকারি পরিষেবার উপরই মানুষ নির্ভরশীল৷ পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্তরের প্রাথমিক চিকিৎসা উন্নত৷ কিন্তু দক্ষিণ ভারতে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত নয় বলে বেসরকারি পরিষেবা শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে৷ সেখানে চিকিৎসা নিয়ে এত বেশি সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয় না৷ পশ্চিমবঙ্গে রোগী ও ডাক্তারের সংঘাতের প্রশ্নে ডাক্তার ভট্টাচার্য জানালেন, ‘‘প্রকৃত প্রশিক্ষিত ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর বা রোগীর পরিবারের কোনও পরিস্থিতিতেই সংঘাত হতে পারে না৷ তবে এ রাজ্যে তো অজস্র ভুয়া ডাক্তারের ছড়াছড়ি৷'' তাহলে কীভাবে পশ্চিমবঙ্গে এই সংঘাত বন্ধ করা সম্ভব?
ডাঃ ফুয়াদ হালিম বলেন, এই নৈতিকতার প্রশ্ন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই৷ যেহেতু চিকিৎসার মতো স্পর্শকাতর বিষয়টি পরিচালনার ক্ষমতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে, তাই ক্রেতা বা রোগীর কাছে জীবনরক্ষাই বড় হয়ে দাঁড়ায়, তাঁর পক্ষে চিকিৎসা পরিষেবার জটিল ব্যাপারটি বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না৷ একটাই পথ, সমগ্র চিকিৎসা ব্যবস্থার জাতীয়করণ করতে হবে৷ বেসরকারি সংস্থা পরিষেবা দিলেই আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠবে৷ কিন্তু বিশ্বায়নের দুনিয়ায় বেসরকারি উদ্যোগকে সম্পূর্ণ নাকচ করে এগোনো সম্ভব নয়৷ তাছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিকল্প সরকারি পরিকাঠামো গড়ে তুলতে বিপুল পুঁজির দরকার৷ সেটা জোগানোর মতো পরিস্থিতি কোনও রাজ্য সরকারেরই নেই৷
পায়েল সামন্ত