ক্ষমতাসীনের ব্যর্থতাই বিএনপির ভরসা
২০ নভেম্বর ২০১৮রেষারেষি, টানাপোড়েনের সলতেয় আগুনটা নিশ্চয় নেভেনি, তদুপরি আপাতত চিরচেনা চাপানউতোর আকস্মিক থমকে, দলীয় সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সম্ভাবনা সত্যিই দিগন্তরেখায় উদ্ভাসিত, সবার চোখ তাই আটকে ডিসেম্বরের একাদশ সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণে৷
আর ওই আন্তদলীয় বিবাদ-বিসম্বাদ, মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতার সংকোচন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, ধরপাকড়, ভিন্নমত অবদমন, নাগরিক সমাজ ও বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতার ক্ষয়, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিস্তেজ হয়ে পড়া, প্রধান বিরোধী দলগুলোর ক্ষমতাসর্বস্ব মোহগ্রস্ততা, ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার মতো অভিযোগের মধ্যে বাংলাদেশ এশিয়ার একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটিয়েছে৷ এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণে মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা – এ তিনটি সূচকের যে কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে৷ এছাড়া ওই শর্ত পূরণে ন্যূনতম মাথাপিছু আয় ১২৩০ মার্কিন ডলার থাকলেও বাংলাদেশের তা ১৬১০ মার্কিন ডলার৷ তেমনি মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ দরকার হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯৷ অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম, যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ৷ চলতি মাসের গোড়ায় খোদ বিলিতি প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলেছে, ৭ দশমিক ৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিময়তা এখন ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে তীব্র৷
কিন্তু উপরের চিত্রটার বিপরীতে অর্থনীতিবিদদের অবিরাম সতর্কীকরণটা থাকছেই যে, রাজনৈতিক বোঝাপড়াটা লাগবেই৷ ওই উন্নয়নের ধারাটা টেকসই করতে হলে সুশাসন, আইনের শাসনের ন্যূনতম শর্তগুলো প্রতিপালন করতেই হবে৷ হেনরি কিসিঞ্জারের সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়ি' থেকে আজকের বাংলাদেশ ও তার জনগণের ‘উন্নয়নের ঝুড়ি' হওয়ার নেপথ্যে দীর্ঘকাল ধরে যে দুটি প্রধান খাত নিয়ামক শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখছে, তার মূল শেকড়টা বিদেশের মাটিতেই রয়ে গেছে৷ এর মধ্যে একটি হলো তৈরি পোশাক রপ্তানি আর প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ৷ তৈরি পোশাকে রানা প্লাজায় গণপ্রাণহানি এবং রেমিট্যান্সের সঙ্গে লেপ্টে আছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরার করুণ উপাখ্যান৷ সমালোচকরা বলেন, ‘জবলেস গ্রোথ'৷ বাংলাদেশের গত দুই দশকের সরকারগুলো সবথেকে বেশি উদাসীন থেকেছে, অভ্যন্তরীণ কলকারখানা নির্মাণ এবং তার মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের কোনো পরিসংখ্যান না প্রকাশের ক্ষেত্রে৷
জনপ্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি শেকড় গেড়েছে, শিক্ষা খাতে জিপিএ ফাইভের বাণ ডেকেছে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে শিক্ষার গুণগতমানের উন্নয়ন ঘটেনি৷ স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসাপ্রার্থী মানুষের প্রতিবেশী ভারতে চলে যাওয়ার প্রবণতা কমেনি৷ তবে সবকিছু ছাপিয়ে মূল চ্যালেঞ্জ হলো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বায়ত্তশাসন ও তার স্বাধীন সত্ত্বায় চলতে দেওয়া৷ সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর হানাহানি ও বিদ্বেষের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে৷ কিন্তু তা নিয়ে বাংলাদেশ সমাজে তেমন কোনো আলোচনা বা আকুতি তৈরি হচ্ছে না৷ সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক যেসব সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ, তা এখনো কাগুজে প্রতিশ্রুতির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে৷ কারণ, দুই প্রধান দলের কেউ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণে বিশ্বাসী নয়৷ ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পরে দুই দলের নেতৃত্বে সংবিধানে অর্ধ ডজন সংশোধনী এসেছে৷ কিন্তু এ সবের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো, আপোশকামিতা৷ জনস্বার্থে এবং সুশাসনের শর্ত পূরণে তারা একটি সংশোধনীও আনেনি৷ এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের দোহাই দিয়ে যেসব সাংবিধানিক সংশোধনী কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে জনপ্রিয় তর্ক-বিতর্ক করা হয়, সেই বিষয়ে দুই বড় দলই প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হওয়া থেকে বিরত থাকছে৷ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিনাশী জেনারেল জিয়াউর রহমানের ফরমানগুলো বাতিলে বিএনপি তো নীরবই, কিন্তু আওয়ামীলীগও মুখে সামরিক ফরমানের তীব্র সমালোচনা করলেও তারা অন্তত চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ফরমানগুলো টিকিয়ে রাখছে৷ তারা বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরছে না৷ এমনকি তারা রাষ্ট্রধর্ম টিকিয়ে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে যুক্ত করে রেখেছে৷ এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণে দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত, তথা সমাজকে প্রস্তুত করার মতো কোনো উদ্যোগ নিতে তারা সুপরিকল্পিতভাবে বিরত থাকছে৷ বরং নির্বাচনী রাজনীতিতে তারা তাদের সুপরিচিত আদর্শিক অবস্থানকে জলাঞ্জলি দিতেও যথারীতি কার্পণ্য করছে না৷ এর আগে আওয়ামীলীগকে আমরা হাফেজ্জি হুজুরের খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে গোপন চুক্তি করতে দেখেছি৷ এবারে হেফাজতে ইসলামের আমীর মাওলানা আল্লামা শফির সঙ্গে প্রকাশ্য সমঝোতা করতে দেখলাম৷ অথচ দরকার ছিল মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন এবং ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার, যা তারা করার তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিতেই পারল না৷
২০১৪ সালের পর থেকে সংসদের বাইরের প্রধান বিরোধী দল সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার৷ কিন্তু তারা জনসভার স্বাধীনতাকে কাজে লাগিয়ে কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প উপস্থাপন করতে পারছে না৷ তাদের ভোটে জেতার যতটা সম্ভাবনা তার মূলে রয়েছে ক্ষমতাসীন সরকারের নানা অপারগতা ও ব্যর্থতা৷ এটাই ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশি বিরোধী দলগুলোর পুঁজি৷ আসন্ন নির্বাচনেও তার কোনো ব্যত্যয় দেখা যাচ্ছে না৷ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হয়েছে৷ একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলারও বিচারিক আদালতের রায় মিলেছে৷ কিন্তু রাজনৈতিক বিভাজন অপনোদনে কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়ার কোনো লক্ষণ নেই৷ গণভবনের সংলাপে গিয়ে বিএনপির নেতারা সেই নির্দলীয় সরকার চাই, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই, ধরপাকড় বন্ধ চাই – এ সব বলার বাইরে তারা যেতে পারেনি৷ বিএনপি ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার পরে বলেছিল, আওয়ামীলীগই করেছে৷ এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে তারা আজও দুঃখ প্রকাশ করতে পারেনি৷ বিএনপি তার শাসনামলে কালো ডিজিটাল ৫৭ ধারা সৃষ্টির জন্যও ক্ষমা চাইছে না৷ অথচ বেগম খালেদা জিয়া তার ‘ভিশন ২০৩০' প্রকাশকালে বলেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে রিকন্সিলিয়েশন করবেন৷ বিএনপি গণভবনের সংলাপকে কাজে লাগিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১ হাজার ২টি গায়েবি মামলা ও ৩৬ হাজার ২২৬ জন আসামীর নামের ‘আংশিক' তালিকাই দিতে পেরেছে৷
কোনো সন্দেহ নেই, আসন্ন নির্বাচন এবং শান্তিপূর্ণভাবে নতুন সরকারের পদযাত্রা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ৷ রাজনৈতিক অস্থিরতার অসহায় বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ, হতাহতের শিকার হওয়া মানুষগুলোর পরিবার বিচার বা ক্ষতিপূরণ কোনোটিই পাচ্ছে না৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপির সংঘাতে ৬৪ নিহত এবং ৩৮৮৬ আহত হয়েছেন৷ এইসময়ে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের মধ্যকার আটশ'র বেশি সংঘাতেও কিন্তু ১৪৬ জন নিহত এবং ১০ হাজারের বেশি আহত হয়েছেন৷ দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এ সব সহিংসতার বিচারের হার সবথেকে কম৷ খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়৷ গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট (এসিএলইডি) বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ গত ৮ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় (প্রধানত দুই দলের বৈরিতা) ২০ শতাংশের বেশি ঘটনায় সাধারণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে৷
এরকম একটি প্রেক্ষাপটে অনেকটা আকস্মিকভাবেই দুই যুযুধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন মোর্চা সম্প্রতি গণভবনে একটা সংলাপ করেছে৷ এখন নির্বাচনের তফসিল দ্বিতীয় দফা না পেছালে বাংলাদেশের জনগণ ৩০ ডিসেম্বরে ভোট দিতে যাবে৷ এই ভোট অবাধ না হওয়াসহ নানা শংকা আছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সার্বিক বিবচেনায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার থেকে অপেক্ষাকৃত ভালো বিকল্প প্রধান বিরোধী দলের আর নেই৷ ২০১৯ সালের গোড়ায় শান্তিপূর্ণ ভোটাভুটি, নাকি একটি অনিশ্চয়তার হাতছানি, সে বিষয়ে এখনই হলফ করে বলা যায় না৷
তবে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অবাক করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাহাত্তরের সংববিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে শ্রদ্ধাভাজন ড. কামাল হোসেন একসঙ্গে বসেছেন৷ মধ্য বাম ঘরানার ড. কামাল হোসেন তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কখনো মধ্য ডানের সঙ্গে মোর্চা করেননি৷ এবারই এটা প্রথম ঘটল৷ এমনকি ঐক্য ফ্রন্টভুক্ত হয়ে নির্বাচনি ক্যারিয়ারে নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট মুখোমুখি বসেছে৷ বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোগী ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দূরত্ব বহুদিনের৷ কিন্তু সংলাপের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে তিনি দ্রুততার সঙ্গে সাড়া পেয়েছেন৷
দুদফা সংলাপে বরফ গলার কোনো কথা ছিল না৷ এবং সেটা ঘটেওনি৷ তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রায় একমত যে, সংলাপটা যে হতে পারল, সেটিইি একটি বড় ঘটনা৷
ঢাকায় নতুন জার্মান রাষ্ট্রদূত যোগ দিয়েছেন গত আগস্টে৷ এর আগে তিনি সংঘাতের আরেক রাষ্ট্র রুয়ান্ডায় ছিলেন৷ সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে আলোচনায় তাঁকে আশাবাদী মনে হলো৷ এর আগে একটি ‘জার্মান থিংকট্যাংক' স্বৈরতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছিল৷ তিনি অবশ্য মনে করেন, যে ধারণা বাইরে থেকে তাঁর ছিল, সেটা বদলেছে৷ বাংলাদেশকে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন বলার পক্ষপাতী তিনি নন৷ আসন্ন নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে, এটাকেই বিরাট অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন তিনি৷