1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্রিকেট বনাম বাকি সব খেলার লড়াই

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১৯ মে ২০২৩

লড়াইটা এখনো অসম৷ কিন্তু তাই বলে ভারতে অন্য খেলার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, এমন নয়৷ বরং ফুটবল, কাবাডি, হকির মতো খেলা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে৷

https://p.dw.com/p/4RZL7
ভারতের প্রো কাবাডি লিগ৷
২০২২-সালে ভারতের প্রো কাবাডি লিগ টিভিতে দেখেছেন ২২ কোটি মানুষ৷ (ফাইল ছবি)ছবি: DW/C.Gill

ছেলেবেলায় আমাদের খেলাধুলোও বদলে যেত ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে৷ ক্রিকেট কেবল শীতকালে৷ সেই সঙ্গে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন চলত৷ গরম ও বর্ষায় ফুটবল ছাড়া আর কোনো খেলার কথা মাথাতেই আসত না৷ গ্রামের দিকে কাবাডিও ভয়ংকর জনপ্রিয়৷ এখন তো সারা বছরই ক্রিকেট৷ কলকাতায় তখন পুরোদমে হকি খেলা হতো৷ আমি যখন ক্সাস ফাইভে, তখন আমার একাধিক বন্ধুর প্রথম প্রেম ছিল হকি৷ ১৯৮৩ সালে ভারত একদিনের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার পরিস্থিতি বদলে গেল৷ তারপর থেকে ধীরে ধীরে ক্রিকেট হয়ে গেল জাতীয় খেলা৷ শচিন টেন্ডুলকর হয়ে গেলেন ক্রিকেটের ঈশ্বর৷ সৌরভের ড্রাইভ, দ্রাবিড়ের কপিবুক ক্রিকেট, ভিভিএস লক্ষ্মণের লড়াই, যুবরাজের ফ্ল্যামবয়েন্স, কুম্বলের স্পিন নিয়ে তখন মেতে উঠেছে সারা দেশ৷ লর্ডসে সৌরভের জার্সি খুলে মাথার উপর ঘোরানো নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে, তা কেউ বলতে পারবেন না৷ এখন সারা বছর ধরে ক্রিকেট৷ ৪২ ডিগ্রি গরমেও মাঠে ক্রিকেটাররা৷ ভরা বর্ষাতেও৷

আইপিএল আসার পর থেকে তো উত্তেজনা ও বিনোদন অন্য পর্যায়ে চলে গেল৷ শাহরুখ খান, জুহি চাওলা, প্রীতি জিন্টা, শিল্পা শেট্টিরা ফ্র্যাঞ্চাইজি কিনে ফেললেন৷ অন্য তারকাদেরও নিয়মিত দেখা যেতে লাগলো ক্রিকেটের মাঠে৷ ক্রিকেটও বদলে গেল৷ দর্শকদের উত্তেজনাও৷ কোন খেলায় এমন উত্তেজনা তৈরি হয়? শেষ ওভারে লাগবে ৩০-এর বেশি রান৷ শেষ পাঁচ বলে পাঁচটি ছয় মেরে সেই ম্যাচ জিতে যাচ্ছে কোনো দল৷ আবার শেষ ওভারে দরকার আট-১০ রান৷ তখন অসাধারণ বল করে টিমকে জিতিয়ে দিচ্ছে কোনো অখ্যাত বোলার৷ তারা উঠে আসছে একেবারে সাধারণ ঘর থেকে৷ যশস্বীর মতো মালির টেন্টে থাকা প্লেয়ার বা রিঙ্কু সিংয়ের মতো গ্যাসের সিলিন্ডার বিলি করা বাবার ছেলে উঠে আসছে শিরোনামে৷ ক্রিকেট তখন আর শুধু খেলা বা বিনোদন থাকে না, হয়ে ওঠে স্বপ্নপূরণের কাহিনি৷ ২২ গজের পিচ হয়ে ওঠে রূপকথার গল্পের ভিত্তি৷ বাবা-মায়ের হাত ধরে ক্রিকেট কোচিং ক্যাম্পে বাচ্চাদের লাইন বাড়ছে৷

ক্রিকেটে সাফল্য মানেই রাতারাতি খ্যাতি, টাকা, বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে যাওয়া, ভারত তো বটেই এই উপমহাদেশ, এমনকি পুরো দুনিয়াতেই তারকা হয়ে যাওয়া৷ সেই সঙ্গে উন্মাদনা৷  কিছুদিন আগেও সূর্যকুমার যাদবকে কে জানত? এখন সেই সূর্যকুমারই তো কুড়ি-বিশের ক্রিকেটে রাজা৷ কী সব অবিশ্বাস্য শট! ক্রিকেট ব্যকরণে যার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ উইকেটের সামনে-পিছনে-পাশে সর্বত্র তিনি ছয় মারতে পারেন৷ আগে যেটা ভাবা যেত না, সেটাই হচ্ছে৷ ১২-১৩ বলে অর্ধশতরান, ৩০-৩৫ বলে সেঞ্চুরি৷ এই উত্তেজনা, এই বিনোদন, এই ভালোলাগা পেতে ক্রিকেট খেলাটা জানারও দরকার নেই৷ অফ স্টাম্পের বল মারতে গেলে মাথা, পা কোথায় থাকবে তানিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই৷ ডিপ ফাইন লেগ ফিল্ডার মাঠে কোথায় থাকে তা জেনেই বা কী হবে? এখন তো দেখা হয়, চার, ছয় না আউট, কোনটা হচ্ছে৷  তাই প্রচুর দাম দিয়ে টিকিট কেটে মাঠ ভরাচ্ছেন দর্শকরা৷ আর টিভি বা মোবাইল ফোনে ম্যাচে বুঁদ হয়ে থাকছেন মানুষ৷

এবারের আইপিএলে প্রথম ৩৮টা ম্যাচ শুধু টিভি-তে দেখেছেন ৪৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ৷ এছাড়াও ডিজিটালি দেখেছেন কোটি কোটি মানুষ৷ সাধে কী ২০২৩ থেকে ২৭ পর্যন্ত টিভি সত্ত্ব কিনতে ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা দিয়েছে ব্রডকাস্টার কোম্পানি৷ এমনকি মেয়েদের ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ডাব্লিউপিএলের ফাইনাল খেলা দেখেছেন এক কোটিরও বেশি মানুষ৷

এতকিছু বলার পরেও একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে৷ ক্রিকেটের মতো না হলেও সম্প্রতি অন্য খেলার দর্শক বাড়ছে৷ ফুটবলের কথাই ধরুন৷ আইপিএলের মতো ফুটবলেও চালু হয়েছে আইএসএল৷ সেখানেও বিদেশি ফুটবলাররা আসছেন৷ প্রতিটি টিম পাঁচজন করে বিদেশি ফুটবলার খেলাতে পারে৷ ২০২২-২৩-এর আইএসএল দেখেছেন ২৬ কোটি মানুষ৷ আগে বাঙালির কাছে ফুটবল ছিল সব খেলার সেরা৷ এখন সেই ফুটবল নিয়ে হইচই হচ্ছে কেরালায়, গোয়ায়, মণিপুরে, বেঙ্গালুরুতে, দিল্লি এবং উত্তরপূর্বে৷ এখন যে মণিপুর অন্য কারণে খবরে এসেছে, সেই রাজ্য থেকে রাশি রাশি ফুটবলার উঠে আসছে৷ দক্ষিণ ভারত থেকে, পশ্চিম ভারত থেকে আসছে৷ ভারতীয় ফুটবলারেরা বছরে বহু কোটি টাকা পাচ্ছেন৷ বিজ্ঞাপন আসছে৷ জিকোর মতো বিশ্বখ্যাত ফুটবলার দুই বছর গোয়ার কোচ ছিলেন৷ এখন আইএসএলের ক্লাবে সবচেয়ে বেশি কোচ স্প্যানিশ৷ ধীরে ধীরে ফুটবলের চেহারাও বদলে যাচ্ছে৷

যেমন বদলে গিয়েছে কাবাডির চেহারা৷ একসময় এই উপমহাদেশের গ্রামেগঞ্জের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা প্রাণ ফিরে পেয়েছে প্রো-কাবাডি লিগের কল্যাণে৷ ২০২২-এ প্রো কাবাডি লিগ টিভিতে দেখেছেন ২২ কোটি মানুষ৷ আগের বছরের তুলনায় টিভি-দর্শক ১৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

২০২১ সালে ওড়িশায় হকির জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছিল৷ সেই খেলাও দেখেছেন ১০ কোটি মানুষ৷ এই সব সংখ্যাতত্ত্ব একটা জিনিস প্রমাণ করছে, শুধু ক্রিকেট নয়, অন্য খেলার প্রতিও উৎসাহ বাড়ছে৷ মানুষ দেখছেন৷ নতুন প্লেয়ার আসছে৷ ভালো কোচ আসছেন৷ হরিয়ানায় যান৷ সেখানে অন্যতম জনপ্রিয় খেলার নাম কুস্তি৷ এই কুস্তিগিরেরা অলিম্পিক থেকে মেডেল আনছেন৷ হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপূর্ব ও অন্য জায়গা থেকে উঠে আসছেন বক্সারেরা৷ গোপীচাঁদের কাছে ব্যাডমিন্টন কোচিং নেয়ার জন্য লাইন লেগে থাকে৷ শিলিগুড়িতে ক্রিকেট, ফুটবলের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার নাম টেবিল টেনিস৷ নীরজ চোপড়া জ্যাভলিনে অলিম্পিক পদক পাওয়ার পর সেটাও জনপ্রিয় হচ্ছে৷ অভিনব বিন্দ্রার শুটিংয়ে অলিম্পিক পদক পাওয়ার পরেও তাই হয়েছিল৷ এখন তো অনেক স্কুল, কলেজে শুটিং শেখার ব্যবস্থা থাকছে৷

সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে জনপ্রিয়তাও আসে৷ আর এখন যদি কোনো খেলার উপর টিভি, বেসরকারি সংস্থা, বিজ্ঞাপনদাতাদের নজর পড়ে, তাহলে তার ভাগ্য খুলে যায়৷ ১৪২ কোটির দেশ৷ জনসংখ্যা যেমন বোঝা, তেমনই এর একটা সুবিধার দিকও আছে৷ দেশের কয়েক কোটি মানুষ যদি কোনো খেলা সম্পর্কে উৎসাহী হয়, তাহলেই বিজ্ঞাপনদাতারা সেখানে ঝাঁপাবে৷

আর আইপিএল, আইএসএল, প্রো লিগ কাবাডির মতো পেশাদার লিগগুলি অনেক হিসাব বদলে দিচ্ছে৷ বদলে দিচ্ছেন গোপীচাঁদেরা৷ সাইনা নেহওয়াল, পি ভি সিন্ধু পারুপল্লি কাশ্যপ, শ্রীকান্ত কাদম্বিরা তো এখন তারকা৷ একটা একাদেমি কীভাবে পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে, গোপীচাঁদ তার উদাহরণ৷

তাই বলছিলাম, ক্রিকেট থাকবে, ক্রিকেট তারকাদের নিয়ে উন্মাদনা থাকবে, খেলার জগতে দেশের এক থেকে পাঁচ নম্বর জায়গা ক্রিকেট অধিকার করে থাকবে৷ কিন্তু তারপরেও ফুটবল, কবাডি, হকি, ব্যাডমিন্টন, শুটিং, কুস্তিও থাকবে৷ তাই হতাশ হওয়ার সময় আসেনি৷ বরং বর্তমান সময়ের কথা ভেবে, বিভিন্ন খেলার অ্যাসোসিয়েশনকেও কৌশল নিতে হবে৷ এখন তো শুটার, অ্যাথলিট, সাঁতারু থেকে শুরু করে অনেক খেলার সঙ্গে যুক্তরা নিয়মিত বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন৷ সেই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে৷ একজনের সাফল্য পুরো খেলার স্থিতি বদলে দিতে পারে৷ অভিনব বিন্দ্রা, প্রকাশ পাড়ুকোন, গোপীচাঁদ, মেরি কমরা তার প্রমাণ৷

২০১৯ সালের ছবিঘরটি দেখুন...

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷