কোটা আন্দোলনের সমন্বয়করা একের পর এক পুলিশ হেফাজতে
২৮ জুলাই ২০২৪কোটা সংস্কার আন্দোলনের একজন নারী শিক্ষার্থীসহ ছয়জন সমন্বয়ককেও গোয়েন্দা বিভাগের(ডিবি) হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরাও গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এই অভিযান থেকে ছাত্র এবং সাধারণ মানুষও রেহাই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রোববার সচিবালয়ে এক ব্রিফিং-এ আন্দোলন ও সহিংসতায় ১৪৭ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, "মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছাত্র, পুলিশ সদস্যসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ রয়েছেন। পরে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানানো হবে।”
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে গত ২০ জুলাই থেকে সারাদেশে এপর্যন্ত আট দিনে দুই হাজার ৭৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর রবিবার মধ্য রাত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২২৮ জনকে। এই সময়ে মামলা হয়েছে ২২৯টি। ২৪ ঘণ্টায় মামলা হয়েছে ২২টি।
আর র্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে তারা নাশকতার অভিযোগে আট দিনে মোট ৩০৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরমধ্যে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৭ জনকে। আর সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১২ দিনে সারাদেশে মোট ৯ হাজার ৬৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়কারী এখন ডিবি হেফাজতে আছেন। ডিবি দাবি করেছে, নিরাপত্তার কারণে তাদের হেফাজতে নেয়া হয়েছে। তারা হলেন নুসরাত তাবাসসুম, নাহিদ ইসলাম,আসিফ মাহমুদ, সারজিস আলম,হাসনাত আবদুল্লাহ ও আবু বাকের। তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এছাড়া বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবকেও হেফাজতে নেওয়ার কথা জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন ,"নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের ডিবির হেফাজতে আনা হয়েছে। তাদের পরিবারের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী আরিফ সোহেলকেও ডিবি পরিচয়ে তুলে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাকে রবিবার ভোররাতে ঢাকার মনসুরাবাদ হাউজিং এস্টেটের বাসা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তুলে নেয় বলে তার পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তবে পুলিশ এখানো তাকে তুলে নেয়ার কথা স্বীকার করেনি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়কারী হাসিব জামান ডয়চে ভেলেকে অভিযোগ করেন," আমাদের শীর্ষ সমন্বয়কারীদের ডিবি হেফাজতে নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এটার মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন দমনের অপতৎপরতা চালানো হচ্ছে।”
তিনি বলেন," আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমন্বয়কারীকেও আটক করা হয়েছে। আটকের কারণ হিসাবে পুলিশ নিরাপত্তার কথা বলছে। আমরা মনে করি আমরা ঘরেই সবচেয়ে নিরাপদ। আমাদের সমন্বয়কারীদের পুলিশ হেফাজতে নিয়ে তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা হচ্ছে। আমরাও ভয়ের মধ্যে আছি কখন কাকে ধরে নিয়ে যায়।”
ডিবি হেফাজতে থাকা নাহিদ ইসলামের মা মমতাজ নাহার রোববার দুপুরে ডিবি কার্যালয়ের সামনে গিয়েছিলেন তার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু তাকে দেখা করার সুযোগ বা ডিবি কার্যালয়ে ঢুকতে দেয়া হয়নি। মমতাজ নাহার সেখানে সাংবাদিকদের বলেন," ডিবি বলছে নিরাপত্তার কারণে তাদের কাছে রেখেছে। সন্তান মা-বাবার কাছে নিরাপদ। ডিবি অফিসে কিসের নিরাপত্তা।''
তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। সে কি আদৌ ডিবি অফিসে আছে, সেটাও নিশ্চিত হতে পারছি না।আগে একবার নাহিদকে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। এবারও মারধর-নির্যাতন করা হচ্ছে কি না শঙ্কিত।''
বিএনপি জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত তাদের দুই হাজার ৫৩৬ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে ২০৭ টি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম ,যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানিসহ আরো শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ডয়চে ভেলেকে বলেন," সরকার এখন কোটা আন্দোলনের দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের গণগ্রেপ্তারে নেমেছে। এইসব নাশকতার সঙ্গে বিএনপি কোনোভাবে জড়িত নয়।”
তার কথা," এইসব দমন নিপীড়ন চালিয়ে কোনো কাজ হবেনা। পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। এই সরকার জনগণের আস্থা হারিয়েছে। তাদের কোনো জনভিত্তি নেই। এসব করে তারা ক্ষমতায় টিকতে পারবেনা। তাদের বিদায় নিতেই হবে।”
এদিকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষ, পথচারী ও স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদেরর গ্রেপ্তারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাধারণ মানুষ এখন তাদের স্বজনদের খোঁজ পেতে ডিবি অফিস, কারাগারের সামনে এবং আদালত এলাকায় ভিড় করছেন। আর ঢাকার মেস বাড়ি, বিশেষ করে যেখানে ছাত্ররা থাকেন তারা আতঙ্কে আছেন। কারণ পুলিশ এখন ছাত্রদের মেসগুলোকে টার্গেট করেছে।
ঢাকার মীরবাগ এলাকার জয়দর আলী অভিযোগ করেন এক সপ্তাহ আগে তার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে হাসান আরাফাত আকাশকে পুলিশ আটক করে। সে বাসার সামনে মেবাইল ফোন দিয়ে পুলিশ টহলের ছবি তুলছিলো। এত দিন তিনি তার সন্তান কোথায় আছে তা জানতেও পারেননি। রোববার কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে জানতে পারেন তাকে সেখানে রাখা হয়েছে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন," আমার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে দেখা করতে দেয়া হয়নি। তার কী অপরাধ আমি জানিনা। বাচ্চা ছেলে কৌতূহলবশত পুলিশের ছবি তুলেছিলো।”
ঢাকার মাইলস্টোন কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আলিফ হাসান আট দিন আগে সংঘর্ষ চলাকালে আজিমপুর এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর তার বাবা তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে পুলিশ তাকে ও তার বাবাকে আটক করে। বাবাকে পুলিশ ছেড়ে দিলেও আলিফ এখনো কারাগারে আটক আছেন। তার বাবা রাইসুল ইসলাম জানান," আমরা ছেলে আজিমপুর থেকে বাসার দিকে আসার সময় গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলো। সে কোনো আন্দোলনে ছিলোনা। পরে হাসপাতাল নেয়ার পথে আগারগাঁ এলাকা থেকে তাকে আটক করে। এই পর্যন্ত তার সঙ্গে আমি দেখা করতে পারি নাই। কারাগার থেকে বলা হয়েছে সরকার অনুমতি না দিলে দেখা করা যাবেনা। জানিনা আমার ছেলে কেমন আছে। তার চোখের কী অবস্থা তা নিয়ে আমার পরিবারের সবাই চিন্তিত।”
এরকম আরো অনেক অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বাড্ডা এলাকার একটি রডের দোকানে কাজ করা কিশোর শান্তকে(১৫) গত সোমবার পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। তার মা সাজেদা বেগম জানান, তার ছেলে কৌতূহলী হয়ে কারফিউ দেখতে বেরিয়েছিলো।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন," আমরা এখন বাইক রেইড দিয়ে নাশকতাকারীদের ধরার চেষ্টা করছি। আমাদের কাছে তালিকা আছে। সেই তালিকা ধরে এলাকাভিত্তিক অভিযান চালাচ্ছি। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় না আনা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে।”
মামলা বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চলছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, "মামলা তো সবার বিরুদ্ধে হয়নি। আমরা তো সবার নাম জানিনা। আমাদের কাছে অনেক ছবি আছে, ভিডিও ফুটেজ আছে,তালিকা আছে সেটা দেখে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরা সন্দেহভাজনদেরও গ্রেপ্তার করছি।”
ছাত্র , অপ্রাপ্তবয়স্ক ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন," আমরা কোনো গণগ্রেপ্তার করছিনা। নাশকতাকারীদের গ্রেপ্তার করছি। আমরা শিক্ষার্থী বুঝিনা। আমরা বুঝি নাশকতাকারী। যারা নাশকতা, ভাঙচুর, আগুন সন্ত্রাস এসব করেছে তাদেরকে আমরা গ্রেপ্তার করছি।”