কেমন আছেন পাহাড়ি নারীরা?
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১বাংলাদেশে অবশ্য অপরাপর সমাজব্যবস্থা থেকে পাহাড়ি সমাজব্যবস্থা কিছুটা উদার৷ যেমন, পাহাড়ি সমাজে পর্দাপ্রথা নেই এবং নারীর শ্রমের ওপর নেই কোনো অলিখিত বিধিনিষেধও৷ পাহাড়ি নারীরা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন৷ অর্থাৎ, চলাফেরায় তাঁরা অনেকটাই স্বাধীন৷ সত্যিই কি তাই? প্রশ্ন করি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানমকে৷ তিনি জানান, ‘‘রংপুর, দিনাজপুর, গারো পাহাড় বা নেত্রকোনার আদিবাসীদের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বা রাঙামাটির যে আদিবাসীদের কিন্তু অন্যরকম বাস্তবতা৷ আজকে আদিবাসী বলেই কিন্তু কবিতা চাকমাকে আমরা হারাই নি৷ ঐখানে একটা সহিংস, সন্ত্রাসী এবং একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফলে ঘটনাটা ঘটেছে৷ তাই আমার মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামের নারীরা অনেক ব্যাপারে স্বাধীন হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের বা বিরোধের শিকার হয়ে যান তাঁরা৷''
১৯৯৭ সালের ৮ই মার্চ বাংলাদশে প্রথমবারের মতো জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষিত হয়৷ বাংলাদেশের নারীদের জন্য এটা নিঃসন্দেহে অগ্রগতির একটি মাইলফলক৷ জোট সরকারের আমলে এ নীতিমালায় নেতিবাচক সংশোধনী আনা হয়৷ ২০০৮ সালের ৮ই মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরেকটি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করে৷ কিন্তু এতেও আদিবাসী নারীদের বিষয়টি বরাবরের মতোই উপেক্ষিত রয়ে যায়৷
পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই নারীকে সব সময় অধীনতার প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ৮০ শতাংশের বেশি নারী ঘরের বাইরে কাজ করে থাকেন৷ তা সত্ত্বেও সম্পদের ওপর পাহাড়ি নারীদের অধিকার না থাকায়, পুরুষের চেয়ে নারীরা আজও অনেকটাই পিছিয়ে৷
পাহাড়ি সমাজের প্রচলিত উত্তরাধিকার প্রথায় পুত্রসন্তানই সম্পদের একক অধিকারী হিসেবে গণ্য হয়৷ প্রথাগত আইনের মাধ্যমে নারীদের এ অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে৷ ফলে সম্পত্তির ওপর নারীর মালিকানার বিষয়টি পরিবারের পুরুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই নির্ভরশীল৷ কেবল দান বা উইলের মাধ্যমে নারীরা সম্পত্তির অধিকার লাভ করতে পারেন৷ এছাড়া, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী অধিকার লাভ করতে পারেন৷ তবে অপুত্রক অবস্থায় অন্য কোথাও বিয়ে হলে, তিনি প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তির ওপর অধিকার হারান৷
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক কাঠামোর অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ' ও ‘আঞ্চলিক পরিষদ'৷ এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদে নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ রয়েছে৷ ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর, পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোয় ১৯৯৮ সালে সংশোধনী আনা হয়৷ সেই সংশোধনীর মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলোয় দুজন পাহাড়ি এবং একজন বাঙালি নিয়ে তিনজন নারী সদস্য অর্ন্তভুক্ত রাখার ব্যবস্থা আছে৷
কিন্তু অন্তর্বর্তী পরিষদে দীর্ঘ একযুগ ধরে কোনো নারী প্রতিনিধিত্ব নেই৷ ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নারীর প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে৷ বর্তমানে যেখানে নারীর মতামতের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নারীর মতামত প্রকাশের অধিকারকে স্থবির করে রেখে দেওয়া হয়েছে৷ অনুরূপভাবে আঞ্চলিক পরিষদেও তিনজন নারী প্রতিনিধির বিধান আছে৷ অথচ সেখানেও তাঁদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়৷
শুধু সংখ্যালঘুদের ভোট পাওয়ার জন্য নয়, বরং সংসদে এমন আদিবাসী নারী প্রতিনিধি থাকা উচিত, যাঁরা আদিবাসী নারীদের স্বার্থ সংসদে তুলে ধরে তাদের নিরাপত্তা ও ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করতে পারবেন৷ সুতরাং, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হলে স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে৷
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথাগত ব্যবস্থায় নারীর উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে সামাজিক আইনে যেমন পরিবর্তন আনা জরুরি, তেমনি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা দরকার৷ তাই এখন সময় এসেছে পাহাড়ি আদিবাসী নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং প্রশাসনিক গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোয় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার৷
প্রতিবেদন: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক