1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে অশান্তি

৯ মে ২০১৯

কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সরব পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল৷ বিরোধী প্রার্থীরাও এখন আধাসেনাদের ভরসায় থাকতে পারছেন না৷ পাঁচ দফার নির্বাচন সম্পন্ন হলেও ছাপ্পা ভোট, ভোটারদের বাধা দেয়া, সংঘর্ষ– কিছুই পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না৷

https://p.dw.com/p/3IE6T
ছবি: DW/P. Samanta

তীব্র দাবদাহের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমশ বাড়ছে৷ নেতা-নেত্রীদের বাক্যবাণে চড়ছে উত্তেজনার পারদ৷ নানা বিষয়ে বিতর্কের মধ্যে ঘুরেফিরে আসছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রসঙ্গ৷ সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে একটি লোকসভা কেন্দ্রের পরিধি৷ একটি লোকসভা আসনে কমবেশি ১৮০০ বুথ থাকে৷ এখন সব বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে নির্বাচন হচ্ছে৷ এই বাহিনীকে নিয়ে গোড়া থেকেই আপত্তি তুলেছিল পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস৷ বিরোধীরা বরং স্বাগত জানিয়েছিল বাহিনীর আগমনকে৷ কিন্তু নির্বাচন যত এগোচ্ছে বাহিনীর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলছে বিরোধীরাই৷ বিরোধী দলের প্রার্থীদের দেখা যাচ্ছে বাহিনীর ভরসায় না থেকে নিজেরাই বুথে বুথে ছুটছেন৷

প্রার্থী যখন বুথে বুথে

আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়, বহরমপুরে অধীর চৌধুরী, হুগলিতে লকেট চট্টোপাধ্যায়, ব্যারাকপুরে অর্জুন সিং ও গার্গী চট্টোপাধ্যায় নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই সক্রিয় ছিলেন৷ তাঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন বুথে ছুটে গেছেন৷ শাসকদলের কর্মীদের সঙ্গে বাদানুবাদ, প্রিসাইডিং অফিসারকে ধমক, তৃণমূলকর্মীদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়া, ইঁটের আঘাতে গাড়ির কাঁচ ভাঙার দৃশ্য উঠে এসেছে৷ এ সবই হয়েছে বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও৷ তাই প্রশ্ন উঠছে নিরাপত্তার এত ঢালাও আয়োজন সত্ত্বেও এই চিত্র কেন?

নির্বাচনের দিন ব্যারাকপুরের বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিংয়ের মুখ ফেটেছে, বহিরাগতদের তাড়া করতে গিয়ে আছাড় খেয়েছেন, প্রার্থী হওয়া সত্বেও তাঁকে বুথে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে৷ অথচ কেন্দ্রীয় বাহিনী বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন৷ অর্জুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা সন্ত্রাসের শিকার৷ তাই আমাদেরই সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে হচ্ছে৷ রাজ্য পুলিশ তৃণমূলের দাস৷ কেন্দ্রীয় বাহিনীও নিজের কাজ করছে না৷ তাই গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে আমাদের পথে নামতে হয়েছে৷’’ হুগলি কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় নিজে বুথে ঢুকে বহিরাগতদের বের করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘একটা জায়গায় দেখি, কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান বিশ্রাম নিচ্ছেন৷ অথচ তখন তাঁর বুথে ডিউটি দেওয়ার কথা৷ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে বাহিনীর, তারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবে কেন?’’

বাংলার বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে: মনোজ চক্রবর্তী

মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীও বুথে ঢুকে তাড়া করেছেন জাল ভোটারকে৷ তাকে ধরে তুলে দিয়েছেন পুলিশের হাতে৷ এরপর অধীরের বিস্ফোরক দাবি– নির্বাচন কমিশনকে ম্যানেজ করে নিয়েছে তৃণমূল৷ কেন্দ্র-রাজ্য বোঝাপড়া রয়েছে৷ তাই বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করছে না৷ জেলা রাজনীতিতে তাঁর ঘনিষ্ঠ, বহরমপুরের কংগ্রেস বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীও নির্বাচনের দিন অধীরের মতো বুথে বুথে ঘুরেছেন৷ তিনি অধীরের দাবিকে সমর্থন করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই কেন্দ্রে যিনি নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক ছিলেন, তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করেননি৷ তাই বাহিনীও সর্বত্র সক্রিয় ছিল না৷ অন্য রাজ্যের অধীনে বাহিনী কাজ করছে, কিন্তু বাংলার বাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে৷ রাষ্ট্রপতি শাসনে নির্বাচন না হলে ভোট লুঠ রোখা যাবে না৷’’

কী বলছে শাসকদল?

বিরোধীরাই যখন বাহিনীর উপর ভরসা রাখতে পারছে না, তখন শাসক তৃণমূলের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা অনুমান করা যায়৷ তারা গোড়া থেকেই বিপুল সংখ্যায় আধাসেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে৷ ব্যারাকপুর লোকসভার অন্তর্গত জগদ্দল বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক পরশ দত্ত নিশানা করেছেন বিরোধী প্রার্থীদের৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘লকেট চট্টোপাধ্যায়, অর্জুন সিংরা নির্বাচনের দিন গুন্ডামি করছেন৷ ওঁরাই তো কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়েছিলেন৷ সব বুথে বাহিনী মোতায়েনের পরও প্রার্থীরা কেন প্রিসাইডিং অফিসারকে শাসাচ্ছেন? তার মানে ওঁদেরই ভরসা নেই বাহিনীর উপর৷’’

ভারতের অনান্য রাজ্যে যেখানে আধাসেনার নেতৃত্বে সুষ্ঠু ভোট হচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই অবস্থা কেন? পরশ বলেন, ‘‘অর্জুন সিং তো বিহার থেকে লোক আনিয়ে অশান্তি করছে৷ ও তো নিজেই বিহারের লোক৷ তাই ব্যারাকপুরকেও বিহার বানিয়ে দিচ্ছে৷’’

ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর আশা ভরসা রাখা যাবে না: প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়

বাহিনীকে নিয়ে বিতর্কে নয়া মাত্রা যুক্ত হয়েছে হাওড়া লোকসভা কেন্দ্রে৷ সেখানকার তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী, প্রাক্তন ফুটবলার  ও বিদায়ী সাংসদ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, তাঁকে আধাসেনার জওয়ানরা মারধর করেছে৷ গত দু'দিন তিনি কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেই কথা বলছিলেন না৷ ডয়চে ভেলের ফোন ধরে প্রসূন বলেন, ‘‘আমার গলায় প্রার্থীর পরিচয়পত্র ছিল৷ আমি কোনো অনিয়ম করিনি৷ বুথের ভেতর ঢোকার অধিকার প্রার্থীর আছে৷ তা-ও আমাকে বাহিনী মেরেছে৷ এটা ওদের কাজ নয়৷ আমার কাছে এই ঘটনা খুবই লজ্জার৷ তাই কারো সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না৷ ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপর আশা ভরসা রাখা যাবে না৷’’

সমর্থন নেই?

এই ঘটনাক্রমে স্পষ্ট, শাসক থেকে বিরোধী, সব পক্ষই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নানা কারণে দায়ী করছে৷ যদিও পঞ্চম দফার নির্বাচনে অধিকাংশ জায়গায় মানুষ শান্তিতে ভোট দিতে পেরেছে বলে প্রশংসাও পেয়েছে আধাসেনা৷ আকছার বাহিনীর দিকে আঙুল তোলার প্রবণতাকে সমর্থন করেন না প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায়, তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজ্য পুলিশকে কেন্দ্রের বাহিনী সহযোগিতা করে৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, রাজ্য এই বাহিনী মোতায়েন ও পরিচালনা করবে৷ কিন্তু, রাজ্য প্রশাসন যদি পক্ষপাতিত্ব করে, তাহলে আধাসেনা কী করবে? তারা রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতায় কাজ করে৷ এটা এক ধরনের সীমাবদ্ধতা বটেই৷’’ অনেকটা এক সুরে ব্যারাকপুরের সিপিএম প্রার্থী গার্গী চট্টোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই রাজ্যে গুন্ডাদের হাতে ক্ষমতা৷ দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় বাহিনী কী করবে? ওরা তো ভগবান নয়৷ রাজ্য সরকার চায় না বাহিনী ঠিকভাবে কাজ করুক৷’’

গ্রামীণ জনতার একটা বড় অংশ অভিযোগ তুলেছে, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে তাঁরা ভোট দিতে পারেনি৷ তাই এই সাধারণ নির্বাচনের আগে সাধারণ মানু্ষ থেকে ভোটকর্মীরা আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েনের দাবি তুলেছিলেন৷ রাজনৈতিক দলগুলির যা-ই অভিযোগ থাক, বাহিনীর উপস্থিতিতে জনতা অনেকটাই ভরসা পেয়েছে৷ তাই ভয় ও সন্ত্রাস উড়িয়ে ভোটের লাইন দাঁড়িয়েছে৷ পঞ্চায়েতে যাঁরা ভোট দিতে পারেননি, তাঁরা এবার ভোট দিতে পেরে খুশি৷ ১২ মে পঞ্চম দফার নির্বাচনে রাজ্যে থাকবে ৭৪০ কোম্পানি বাহিনী৷ তবে ১০০ শতাংশ বুথে আধাসেনা থাকছে না৷ যা-ই অভিযোগ থাক, সব বুথে এবারও বাহিনী চেয়ে ধরনায় বসেছে বিজেপি৷

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷