কৃষি সমস্যার সমাধান ‘বায়োডায়নামিক' চাষাবাদ
১০ ডিসেম্বর ২০১৭মূলত দু'টো কারণে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের আকোলা জেলার নাম সুপরিচিত৷ একটি তুলা চাষ, অন্যটি কৃষকের আত্মহত্যা৷ ঋণের বোঝা, দারিদ্রের দুষ্টচক্র, খরা ও স্বল্প ফলন এ এলাকার কৃষকদের প্রায়ই ঠেলে দেয় আত্মহত্যার দিকে৷ ২৯ বছর বয়সি নাসারি চাভান এ এলাকারই একজন আদিবাসী কৃষক৷ নাসারি যখন চাষের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন, এ এলাকার অন্যান্যদের মতো তাঁদের পরিবারও ধুঁকছিল ঋণের চাপে৷
এসএআরজি বিকাশ সমিতি নামের একটি বেসরকারি সংস্থা, যারা ভারতে বায়োডায়নামিক চাষাবাদ প্রবর্তনে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের একটি ওয়ার্কশপে সাত বছর আগে প্রশিক্ষণ নেন নাসারি৷ এরপরই কীটনাশক ও ক্ষতিকর সার ব্যবহার বন্ধ করে দেন তিনি৷ বছরের পর বছর ধরে অপরিকল্পিত কীটনাশক ও ক্ষতিকারক সারের ব্যবহার জমির যে ক্ষতি করেছিল, জৈব সারের ব্যবহারের ফলে তা পুষিয়ে নিয়ে আবারো উর্বর হয়ে উঠতে শুরু করেছে জমি৷ পরিবারকে ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করে লাভের মুখ দেখেছেন নাসারি৷ এখন ঐ এলাকায় তিনি আর একা নন৷ আরো প্রায় ৫০০ জন চাষী এখন জমিতে জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন৷
২৯ বছর বয়সি এই চাষী সেই অভিজ্ঞতার কথায় শোনালেন অরগ্যানিক ওয়ার্ল্ড কংগ্রেসের মঞ্চে দাঁড়িয়ে৷ এ বছরের নভেম্বরে নতুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় অরগ্যানিক ফার্মিংয়ের উপর আন্তর্জাতিক এ সম্মেলন৷ ‘‘বায়োডায়নামিক চাষাবাদ আমাদের খরচ বাঁচায়, যেহেতু বাইরে থেকে আমাদের কিছুই কিনতে হয় না৷ সেই সঙ্গে এতে করে স্বাস্থ্যকর খাবারও খেতে পারি আমরা৷'' সম্মেলনে আসা বায়োডায়নামিক ও অরগ্যানিক কৃষক ও গবেষকদের সাথে নিজের ভাবনা ভাগাভাগি করে নেন নাসারি৷
বায়োডায়নামিক চাষ পদ্ধতি আলাদা করে সার দেয়ার উপর নির্ভর না করে জমির নিজস্ব বাস্তুসংস্থানের উপর নির্ভর করে৷ ফলে বাড়তি কিছু কেনার প্রয়োজন হয় না৷ এসএআরজি বিকাশ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা বিনিতা শাহ বলেন, ‘‘ঋণের দায়ে জর্জরিত কৃষকদের জন্য এটা এক অনন্য সমাধান৷''
নিউজিল্যান্ডের বায়োডায়নামিক পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষাবাদ করতেন পিটার প্রোক্টর, যাঁর হাত ধরে বিনিতা শাহ ১৯৯০ সালে ভারতে আবারো নতুন করে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন৷ বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানের অধীনে সারা ভারতে ৫ হাজারেরও বেশি কৃষক এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছেন৷
সম্মেলনে অংশ নেয়া বেসরকারি সংস্থা ডেমেটার ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী আলেকজান্ডার গার্বার বলেন,‘‘জার্মানিতে আমাদের প্রায় সতের'শ সনদপ্রাপ্ত চাষিরয়েছেন, ভারতে আছেন প্রায় লক্ষাধিক৷ তবে জমির পরিমাণে পার্থক্য রয়েছে, কারণ ভারতীয়দের ক্ষেত্রে চাষীরা কম জমির মালিক৷ তারপরও এ এক অসাধারণ বিপ্লব এবং ডেমেটার এক্ষেত্রে ‘ব্র্যান্ড' হিসেবে ভারতে কাজ করতে চায়৷''
কৃষিবিদ সার্ভদামান পাটেল বলেন, ‘‘ভারতে চাঁদ-তারার উপর ভিত্তি করে আগেকার দিনে যে চাষাবাদ হতো, এই বায়োডায়নামিক চাষাবাদ তার চেয়ে খুব বেশি আলাদা কিছু নয়৷ কেবল একে আরেকটু যথাযথ ও সময়ের সঙ্গে উপযুক্ত করা হয়েছে বর্তমানে৷'' সার্ভদামান পাটেলের অধীনেই এ চাষাবাদ পদ্ধতি শেখেন জার্মানির সোফিয়া ক্নোবেল্সডর্ফ৷ এই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে তিনিসফল ওয়াইন ফার্মার হতে চান৷
প্রাচীন ভারতের চাষাবাদ পদ্ধতির সাথে এর মিল রয়েছে প্রচুর৷ যেমন এ পদ্ধতিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে গরু৷ গরুর বর্জ্য ব্যবহার করেই ভারতে বায়োডায়নামিক পদ্ধতিতে চাষ দেখেছে সফলতার মুখ৷ তবে কিছু নতুন জিনিসও রয়েছে৷ যেমন শীতের সময় গরুর বর্জ্য ব্যবহার করে যে সার হয়, সেটাই গরুর শিং-এর সাহায্যে মাটিতে পুঁতে দলে জমি পুনরুজ্জীবন লাভ করে৷
সম্মেলনে ভারতের নানা অঞ্চলের কৃষকরা বায়োডায়নামিক পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষাবাদের ফলে তাঁদের ভাগ্যের যে পরিবর্তন হয়েছে, সেই গল্প ভাগাভাগি করে নেন সবার সাথে৷ ভারতের তামিলনাড়ুর ধর্মযাজক ফাদার ক্লেমেন্ট জোসেফ জার্মান সরকারের সহায়তায় একটি প্রকল্পে কাজ করছেন৷ তামিলনাড়ুর দক্ষিণ ভাগে খরাক্রান্ত এলাকায় এই বায়োডায়নামিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের অভিজ্ঞত সম্মেলনে অংশ নেয়া অন্যান্যদের সাথে ভাগ করে নেন তিনি৷
যদিও কেবল এ পদ্ধতির ব্যবহার করেই ভারতের কৃষি সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, তবুও এর মাধ্যমে ক্ষতিকর কীটনাশকের অতিব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব৷ তাছাড়া কেবল গ্রামের কৃষকরাই নন, বায়োডায়নামিক পদ্ধতিতে চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে শহুরে কৃষকদের কাছেও৷
রাজধানীর অদূরে শিল্প শহর হিসেবে খ্যাত নয়ডায় একটি বায়োডায়নামিক ফার্ম রয়েছে, যারা যৌথ খামারের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে চাষাবাদ করছে৷ এ প্রকল্পের অংশীদার আমির আহমেদ বলেন, ‘‘খারাপ খাবার খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে গেছি আমরা৷ তাই ঠিক করলাম কিছু করি৷ তবে এই প্রজেক্টির সঙ্গে আমি আরো অনেক মানুষকে যুক্ত করতে চাই আমরা৷''
সুনয়না কুমার/আরএন