কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মধ্যেও বৈষম্যের বীজ!
১২ জুলাই ২০২১ইন্টারনেটে বিউটি ডট এআই নামের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর মানুষদের বেছে নেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে৷ কারণ মানুষ নয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে৷ সেই ডাকে সাড়া দিয়ে বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে ছয় হাজারেরও বেশি সেলফি পাঠানো হয়েছে৷
কিন্তু দেখা গেল, জয়ীদের সবাই শ্বেতাঙ্গ৷ সমস্যা হলো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে মধ্য ইউরোপের মানুষের মুখচ্ছবির ভিত্তিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে৷ সেই প্রযুক্তি অন্যান্য অঞ্চলের মুখচ্ছবি ভালো করে চিনতে পারে না৷
প্রথম সারির অন্যতম এআই গবেষক জয় বুলামউইনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে আরো গুরুতর বৈষম্যের উল্লেখ করলেন৷ জয় বলেন, ‘‘আমাদের সত্যি ব্যাপক, রহস্যময়, ধ্বংসাত্মক অ্যালগোরিদমের কথা ভাবা উচিত৷ কারণ, এআই ব্যবহার করে এমন সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যেগুলি আমাদের জীবনে একের পর এক ক্ষেত্রের উপর প্রভাব ফেলে৷ কাকে চাকুরিতে নিয়োগ করা হবে, কাকে বরখাস্ত করা হবে, ঋণ বা বিমা পাবে কিনা, পছন্দের কলেজে ভর্তির সুযোগ পাবে কিনা, এআই সে সব স্থির করছে৷’’
কোম্পানিগুলি যে সব সফ্টওয়্যার টুলের সাহায্যে নতুন কর্মী খোঁজে, সেগুলির মধ্যে কয়েকটি এআই ব্যবহার করে৷ সেই প্রযুক্তি শরীরের ভাষা বা শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করে৷ হায়ারভিউ নামের কোম্পানি আরও বস্তুনিষ্ঠ পদ্ধতিতে কর্মী বাছাইয়ের মাধ্যমে আরও ডাইভার্সিটি ও নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করার প্রতিশ্রুতি দেয়৷
লোরেনা খাউমে পালাসির মতো বিশেষজ্ঞদের মনে অবশ্য সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এমন অনেক কৌশল কিছু তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ সামাজিক বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, এমনকি মনস্তত্বের ক্ষেত্রেও বিতর্কিত অথবা বহুকাল ধরে অচল ধারণার ভিত্তিতে কাজ হচ্ছে৷ যেমন ‘বিগ ফাইভ’৷’’
সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে এই ‘বিগ ফাইভ’ বৈশিষ্ট্য হলো খোলামেলা মনোভাব, বিবেকবোধ, মুক্তমনের পরিচয়, সহমর্মিতা ও আত্মবিশ্বাস৷ এআই সব মানুষকে এই সব শর্ত অনুযায়ী ভাগ করে এবং তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়৷ যেমন গুণ হিসেবে সহমর্মিতা নেতৃস্থানীয় পদের সঙ্গে খাপ খায় না৷ মূলত নারীদের ক্ষেত্রেই সহমর্মিতা যুক্ত করা হয়৷ ফলে সফ্টওয়্যারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী নারীরা বস হিসেবে মোটেই উপযুক্ত নন!
আর একটি সমস্যা হলো এই ‘বিগ ফাইভ’ আসলে ইউরোপীয় সমাজের মূল্যবোধ৷ এশিয়া মহাদেশে কঠিন পরিশ্রম আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ গুণ৷ প্রচলিত সফ্টওয়্যার টুলগুলি এই গুণ বিবেচনা করে না৷
ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘কামিও’ নামের এক সফ্টওয়্যার ব্যবহার করে৷ তবে এই মুহূর্তে তাতে এআই থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে না৷ লোরেনা বলেন, ‘‘আমার মতে, সবার আগে এমন সব টুল সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করা উচিত যেগুলি মানুষের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে৷ এমন প্রযুক্তির মাধ্যমে আদৌ সেই কাজ সম্ভব কিনা তা ভাবা দরকার৷ কারণ নৈতিকতা ও বিজ্ঞানের মানদণ্ডের বিচারে এমন অনেক প্রযুক্তির কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ভিত্তি নেই৷ ফলে বাজারে এমন প্রযুক্তি থাকাই উচিত নয়৷’’
তা সত্ত্বেও গোটা বিশ্বে এআই-ভিত্তিক প্রণালীর ব্যবহার বেড়ে চলেছে৷ এআই গবেষক হিসেবে জয় বুলামউইনি মনে করেন, ‘‘আমারা আরও ‘ইনক্লিউসিভ’ কোড ও সব ধরনের মানুষকে শামিল করার কথা ভাবতে পারি৷ মানুষকে কেন্দ্রে রেখেই শুরু করতে হবে৷ আমরা কি সব ধরনের মানুষকে নিয়ে এমন টিম তৈরি করছি, যারা একে অপরের দুর্বলতা পূরণ করতে পারে? প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভাবতে হবে, আমরি কি সিস্টেম সৃষ্টির সময় ন্যায্য হতে পারছি? সামাজিক পরিবর্তনের বিষয়টি পরে না ভেবে সেটিকে অগ্রাধিকার দিলে সাম্য নিশ্চিত করতে আমাদের হাতে আরও সুযোগ আসবে৷’’
মানুষের ন্যায্য মূল্যায়ন করতে হলে অবশ্যই আরো উদ্যোগ নিতে হবে৷ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রোগ্রামারদের সেটা নিশ্চিত করতে হলে আরো অর্থের প্রয়োজন হবে৷
এলিসাবেট লেমান/এসবি