1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘কুমড়া'র টমেটো সসের দেশে, আছি মা রসেবশে

Fatema Abedin, Intern, DW Bangla section.
ফাতেমা আবেদীন
৭ জুন ২০২৪

বাজারে পাওয়া যাওয়া কম বেশি সবপণ্যই অনুমোদনহীন, ভেজাল পাওয়া যায় প্রায়শই৷ সেক্ষেত্রে আপনার সোর্সিং নিশ্চিত করতে হবে অর্গানিক৷

https://p.dw.com/p/4gneO
একটি রেস্টুরেন্টের কিচেন
করোনাকালের তিন বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা আয় হয়েছে অনলাইন উদ্যোক্তাদের ব্যবসা থেকেছবি: Mortuza Rashed/DW

ছোটবেলায় বেশ স্ট্যান্ডার্ড একটি কোম্পানির সরিষার তেল আনা হয়েছিলো আমাদের বাসায়৷ ঝাঁজের চোটে তেল মুখে দেওয়া যেত না৷ কিন্তু ঠাণ্ডা লাগলেই এক চামচ সরিষার তেলের চিকিৎসা শিখেছিলেন আমার বাবা৷ আমাদের খেতেই হতো সেই তেল৷ বহুদিন পর কোনো এক আত্মীয় নিজেদের ভাঙানো সরিষার তেল দিলেন৷ এক ফোটা ঝাঁঝ নেই, কী সুন্দর ঘ্রাণ আর স্বাদ৷ খুবই অবাক হয়েছিলাম৷ সেই তেল খাওয়াতে আমাদের একটুও ঝক্কি হয়নি৷ নাক জ্বলে না৷ বড় হতে হতে বুঝলাম- তেলের মিলে প্রতিনিয়তই নামমাত্র সরিষা দিয়ে সস্তা দামের স্পিন্ডল অয়েলের সঙ্গে বিষাক্ত কেমিক্যাল, কৃত্রিম ঝাঁজ, শুকনো মরিচের গুঁড়া, মাস্টার্ড ও ইস্ট কেমিক্যালসহ রং মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে সরিষার তেল৷

এত গেলো তেলের কথা৷ দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রবাস জীবন শেষে দেশে ফিরে একদিন ঈদের বাজার করতে গেলাম কাওরান বাজার৷ মধ্য গ্রীষ্মকালে বাজারে পোক্ত বড় বড় মটরশুঁটি দেখে মন হুহু করে উঠলো৷ আমি খুশি মনে কেজি দুয়েক মটরশুঁটি কিনে নিজ বাড়িতে চলে আসলাম৷ রাতের বেলা মটরশুঁটি ধুতে গিয়ে দেখি রঙ ওঠে৷ পুরা বেসিন সবুজ৷ আমার মা সব মটরশুঁটি গরম পানিতে দিলেন৷ সবুজ রঙ পানিতে গড়িয়ে বাদামি রঙের অ্যাঙ্কর ডালের দানা আলাদা হয়ে উঠলো৷ অফ সিজনে ২০০ টাকা কেজি মটরশুঁটি কিনেছিলাম৷ ১৪ বছর আগের সেই ৪০০ টাকার শোক আমার আজো কাটেনি৷

এরপর দেশে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আর ভেজালবিরোধী অভিযান আসলো৷ তখন কত গল্প জানলাম- কীভাবে ফরমালিন ব্যবহার হয় খাবারে৷ বিরিয়ানিতে কাপড় রঙ করার রঙ, টমেটো সসের ফ্যাক্টরিতে পচা মিষ্টি কুমড়া, কৃত্রিম রঙ ও কেমিক্যাল, জিলাপি মুচমুচে করতে হাইড্রোজের মতো ক্ষতিকর পদার্থের সঙ্গে পরিচিত হলো বাংলার জনগণ৷

খাদ্য নিরাপত্তা আর নিরাপদ খাদ্য বিষয়েও সচেতন হলাম আমরা৷ কত রোগশোক বেড়েছে ভেজাল খাদ্যের কারণে সেই পরিসংখ্যানও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে৷ কিন্তু আদৌ কি কিছু করতে পারছি আমরা?

সকালে যে মোড়ের দোকান থেকে মুচমুচে পরোটা আনেন, সেটায় মেশানো হয় অ্যামোনিয়াম সালফেট ও ইউরিয়া৷ দোকানিদের ভাষায় এর নাম ‘সাল্টু'৷ অ্যামোনিয়াম সালফেট এবং ইউরিয়া সার একসঙ্গে মিশিয়ে গুঁড়ো করে এই সাল্টু বিক্রি করা হয় মসলার দোকানে৷ ধরেন এসব তো বড়দের খাবার৷ ছোটদের খাবারে কী আছে জানেন কি? গুঁড়া দুধে সীসার উপাদান পাওয়ার ঘটনা পুরানো, দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে প্যাকেটজাত ও খোলা চিনির নমুনা পরীক্ষা করে তাতে সোডিয়াম সাইক্লামেট বা ঘন চিনির অস্তিত্বও পাওয়া গেছে৷

এগুলোর বাইরে আসেন আমরা যারা বাইরে খাই সেসব খাবারে কী কী পাই সেই তালিকায়৷ বিরিয়ানিতে রঙ, খোলা অপরিশোধিত তেল, জিলাপি ভাজতে মবিল ও হাইড্রোজ, কাবাবের ওপরে চকচকা করতে গ্রিজের মতো উপাদান, বনস্পতির নামে ডালডা৷ এর বাইরে মেয়াদহীন আটা, ময়দা, বিভিন্ন মসলা তো রয়েছেই৷ রাসায়নিক মেশানো চাল, কৃত্রিম সুগন্ধী মেশানো চাল, মরিচের গুঁড়ায় ইট, জিরায় কাঠের গুঁড়া, রয়েছে মরা মুরগি, মেয়াদোত্তীর্ণ ফ্রোজেন মাংস, পচা মাছ৷ ভাজার জন্য পামওয়েল, পশুর চর্বি কিংবা অন্য গলনশীল চর্বি ব্যবহার করা হয়৷ মাখন, মেয়োনেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয় অপরিশোধিত সস্তা চর্বি৷ মাংসের কিমা বানানো হয় গরু, ছাগল ও মুরগির উচ্ছিষ্ট অংশ দিয়ে৷ রেস্তোরাঁর ফ্রিজের তাপমাত্রার বিষয়ে আলাপ না করি৷ কিংবা ওভেন চুলার পরিচ্ছন্নতা নিয়েও আলাপে না যাওয়াটাই ভালো৷ বাথরুমের যে তরকারি ধোঁয়া হয় তার চেহারাটা রীতিমতো আতঙ্কের৷

সবাই যে এমন খাবার দেয় এই ভেবে রাগে ফুঁসে যাবেন না৷ পরিসংখ্যান বুর‍্যোর দেওয়া হিসাবে দেশের চার লাখ চল্লিশ হাজারের মতো রেস্তোরাঁ আছে৷ এরমধ্যে মানসম্মত খাবার পরিবেশনকারী গ্রেড পাওয়া রেস্তোরাঁর সংখ্যা মাত্র ৩৬০টি৷ কেমন লাগছে বলুন তো৷

খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ কাজ শুরু করে ২০১৫ সাল থেকে৷ ২০১৩ সালে সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন পাস করে৷ এরপর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ৷ তবে এই সংস্থাটির কাজ শুরু করতে লেগেছে পাঁচ বছর৷ জনবল সংকট ও বাজেটের অভাবে এটি কাজ করতে পারেনি৷ ২০২০ সালে প্রতিটি জেলায় একজন করে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক কর্মকর্তা নিয়ে পুরোদমে কাজ শুরু করে সংস্থাটি৷ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের দাবি মতে- একটি খাদ্যপণ্য নানাভাবে অনিরাপদ হতে পারে৷ একদম কৃষি পণ্য থেকেই এর যাত্রা শুরু হয়৷

চাষাবাসে রাসায়নিক পণ্যের ব্যবহার, কীটনাশক ব্যবহার৷ যেমন ধরুন আমাদের দেশে চাষের মাছকে যে ফিড দেওয়া হয় তাতে অনেক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য রয়েছে৷ আবার চাষ করা মাছ একবারে ধরতে বেশিরভাগ পুকুরে রোটেনন জাতীয় পদার্থ দেওয়া হয়৷ যেটি পানির অক্সিজেন লেভেল কমিয়ে মাছকে ভাসিয়ে তোলে৷ তাহলে কোথায় বিশ্বাস করবেন বলুন৷ গোড়ায় গলদ৷

চলতি বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে বরাদ্দ বেড়েছে সাত হাজার কোটি টাকা৷ মোট বাজেটের প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভাগ সামাজিক নিরাপত্তায়৷ এর মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষি খাতকে দেওয়া হয়েছে দুই শতাংশ বরাদ্দ৷ যদিও বাড়ানো হয়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি৷ কৃষিখাতসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ৩৮ হাজার দুইশ'৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে ২ হাজার তিনশ' ৭৯ কোটি টাকা বেশি৷ কৃষি উৎপাদন উৎসাহিত করতে ভর্তুকি ও যান্ত্রিকীকরণ প্রক্রিয়া চলমান রাখার কথাও উল্লেখ করা হয় বাজেটে৷

বাজেটের হাজার কোটি টাকা সবসময় আমার মাথায় হামলা করে৷ তাই বাজেটটাকে এক পাশে সরিয়ে নিজে কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি একজন খাদ্য উদ্যোক্তা হিসেবে সেটি নিয়ে কথা বলাটাই সহজ আমার জন্য৷

২০২০ সালে যখন আমার রেডি ফুডের প্রতিষ্ঠান এন'স কিচেন যাত্রা শুরু করে তখন করোনা মহামারিতে দেশ অচল৷ সে সময় দেশের সব রেস্তোরাঁ বন্ধ৷ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো হোম কিচেনের ব্যবসা৷ পুরো করোনাকালের তিন বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা আয় হয়েছে অনলাইন উদ্যোক্তাদের ব্যবসা থেকে৷ ঢাকা শহরে করোনা রোগীদের বাড়ির সামনে খাবার রেখে আসার মধ্য দিয়েই আমার কিচেনের পরিচিতি বাড়ে৷

ক্রেতাকে খাবার দেওয়ার ক্ষেত্রে আমি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের  ওয়েবসাইটের দেওয়ালে সাঁটা লিস্টটা বারবার পড়ে নেই৷ আমার সহউদ্যোক্তা যারা আছেন তারাও পড়ে নিতে পারেন৷

খাদ্য নিরাপদ রাখার ৫ চাবিকাঠি:

১৷ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখি (পরিচ্ছন্নতার প্রথম ধাপ, সাবান দিয়ে ধোব হাত; পরিচ্ছন্ন থালা-বাসন, রাখবে সুস্থ সবার জীবন)৷

২৷ কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখি (কাঁচা মাছ/মাংস, ফলমূল বা শাক-সবজি থেকে আলাদা রাখি; কাঁচা ও রান্না করা খাবার আলাদা রাখি)৷

৩৷ সঠিক তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট সময় ধরে খাবার রান্না করি (সঠিক তাপে ভালভাবে সিদ্ধ করে খাবার রান্না করি)৷

৪৷ নিরাপদ তাপমাত্রায় খাদ্য সংরক্ষণ করি (রান্না করা খাবার ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর নিচে সংরক্ষণ করি এবং সংরক্ষণ করা খাবার পরিবেশনের আগে ভালভাবে গরম করি)৷

৫৷ নিরাপদ পানি ও খাদ্য উপকরণ ব্যবহার করি (নিরাপদ পানি ব্যবহার করি, ফলমূল ও শাক-সবজি নিরাপদ পানি দিয়ে ধুয়ে নেই)৷

এখন এর সবগুলো করেও কি আপনি পার পাবেন? যেমন ধরেন রেস্তোরাঁ বা হোম কিচেন থেকে খাবারের সঙ্গে সালাদ পলিপ্যাকে দেওয়া হয়৷ এবং সেই পলিটি স্টেপলার দিয়ে বন্ধ করা হয়৷ স্টেপলারের পিন ভয়াবহ অনিরাপদ একটি বস্তু, কোনোভাবে খাদ্যনালী বা শ্বাসনালীতে চলে গেলে বড় দুর্ঘটনায় পড়তে পারে একজন ক্রেতা৷ তাই সালাদ দিতে একটি বাটি বা জিপলক বা গিট দেওয়া যায় এমন পলি ব্যবহার করুন৷ ব্যবসা করতে গিয়ে এটি আমার লব্ধ জ্ঞান৷ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একজন কর্মকর্তাই আমাকে এই তথ্যটি জানিয়েছিলেন৷

খুব ছোট্ট একটি বিষয়ের অবতারণা করলাম৷ এবার আসুন প্রথম স্তরের খাদ্যপণ্যে যে এত ভেজাল সেগুলো মোকাবিলা করি কীভাবে৷ চাল-ডাল লবণ-মসলার ভেজাল মুক্ত কী করে হবেন? বাজারে পাওয়া যাওয়া কম বেশি সবপণ্যই অনুমোদনহীন, ভেজাল পাওয়া যায় প্রায়শই৷ সেক্ষেত্রে আপনার সোর্সিং নিশ্চিত করতে হবে অর্গানিক৷ চালটা যেখান থেকে আসে সেটির মান নিশ্চিত করুন৷ একইভাবে ডাল, মসলা ও অন্যান উপাদানের শেলফটাইম, নিরাপদ কিনা চেক করে বাজার করুন৷ খাবার তেলটা ভালোমানের ভোজ্য তেল ব্যবহার করুন৷ লাইভ প্রাণির মাংস কেনার চেষ্টা করুন৷ সস জাতীয় যেসব দ্রব্য খাবারে ব্যবহার সেগুলো ঘরেই তৈরি করে নিন৷ কৃত্রিম ফ্লেভার ব্যবহারে বিরত থাকুন৷

সব গেলো এবার নিরাপদ পানি কোথায় পাবেন? ঢাকার পানিতে কলেরার জীবাণু পাওয়া হর-হামেশার ঘটনা৷ তাই পানি ফুটিয়ে ফিল্টার করে রান্নার কাজে ব্যাবহার করুন৷

এখন এসব কাজে আপনার যে ব্যয় বাড়বে এবং খাদ্যপণ্য স্বাভাবিকের চেয়ে দুই গুণ বেড়ে যাবে৷ পুরো মাস ধুমিয়ে ব্যবসা করেও ১০-১৫ শতাংশ লাভ তুলতে আপনার ত্রাহী মধুসূদন দশা হবে সেই দায় আমাদের কারো না৷ প্রথম স্তর থেকে যদি সরবরাহটা নিরাপদ হতো৷ তাহলে অনেক চিন্তা কমে যেত৷ সরকার তো বাজেটে বরাদ্দ দিয়েছেই৷ আশা করি এবার একটা হেস্তনেস্ত হবে৷ আমরাও বেশ ভালো খাবো৷

তবে বিশ্বাস তো একবার উঠে গেছে৷ শতভাগ খাদ্য নিরাপত্তা তো দূরের কথা৷ ৫০ ভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই এই দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য ফিরবে নিশ্চিত৷ আমাদের তখন কুমড়ার টমেটো সস খেয়ে রসেবশে দিন কাটাতে হবে না৷ টমেটো দিয়েই সস বানাবে দেশসেরা কোম্পানিগুলো৷

Fatema Abedin, Intern, DW Bangla section.
ফাতেমা আবেদীন বাংলাদেশের উদ্যোক্তা ও সাংবাদিক