কিউইদের জয়রথ থামিয়ে শীর্ষে ভারত
২২ অক্টোবর ২০২৩প্রথম চার ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ছিল দুর্দম্য৷ ভারতও দুর্ধর্ষ৷ শিরোপা প্রত্যাশী দুই দল শুধু টানা চার ম্যাচ জিতেনি, বরং প্রতিপক্ষকে রীতিমত দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে৷ আজ তাদের লড়াই নিয়ে তাই উত্তেজনার পারদ চড়ে বেশ৷ ব্লকবাস্টার সেই ম্যাচে মোহাম্মদ সামির পর বিরাট কোহলির বীরত্বে ৪ উইকেটে জিতল ভারত৷ পাঁচ ম্যাচে টানা পঞ্চম জয়ে ১০ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রোহিত শর্মার দল৷ সেমিফাইনালের পথেও অনেকখানি এগিয়ে গেল স্বাগতিকেরা৷
২০০৩ বিশ্বকাপের পর আইসিসির সীমিত ওভারের ফরম্যাটে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারেনি ভারত৷ এ সময় রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিরা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হেরেছেন তিনবার৷ গত ওয়ানডে বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের ম্যাচটি বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার পর সেমিফাইনালে জিতেছিল নিউজিল্যান্ড৷
২০ বছর পর বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর আক্ষেপটা দূর হল ভারতের৷ একইসঙ্গে নেয়া হল গত বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হারের মধুর প্রতিশোধ৷ জমজমাট এই ম্যাচটা অনলাইনে দেখেছেন ৩ কোটি ৬০ লাখেরও বেশি দর্শক, যা ক্রিকেট ইতিহাসেই সর্বোচ্চ৷
বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা বিরাট কোহলির ব্যাট হেসেছে আজও৷ তিনি খেলেন ১০৪ বলে ৮ বাউন্ডারি আর ২ ছক্কায় ৯৫ রানের ইনিংস৷ তাতে প্রথম খেলোয়াড় হিসাবে আইসিসি টুর্নামেন্টে (ওয়ানডে বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়নস লিগ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ) তিন হাজার রানের মাইলফলকে পা রেখেছেন কিং কোহলি৷ দুই হাজার ৯৪২ রান নিয়ে কোহলির পর আছেন ক্রিস গেইল৷
শচীন টেন্ডুলকারের ওয়ানডের সর্বোচ্চ ৪৯তম সেঞ্চুরির রেকর্ড আজ কোহলি স্পর্শ করবেন কিনা এ নিয়ে আগ্রহ ছিল ম্যাচ জুড়ে৷ আশাটাও জাগিয়েছিলেন কোহলিও৷ ট্রেন্ট বোল্টের করা ৪৭তম ওভারের ছক্কা ও বাউন্ডারি মেরে ৮২ থেকে পৌঁছান ৯২-এ৷ ম্যাট হেনরির করা পরের ওভারে ৯৫ রানে থাকার সময় নেননি একটি সিঙ্গেলস৷ তবে ঠিক পরের বলেই মিডউইকেট দিয়ে উড়িয়ে মারতে যেয়ে ক্যাচ দেন ফিলিপসকে৷ ভারতের অপ্রাপ্তি বলতে এই সেঞ্চুরি না হওয়াটাই৷
ধর্মশালার আকাশে সকাল থেকেই ছিল মেঘের আনাগোনা৷ সঙ্গে ছিল কনকনে ঠান্ডা৷ এমন কন্ডিশনের সুবিধাটা শুরুতে ভালোভাবে নেন ভারতীয় পেসাররা৷ জাসপ্রিত বুমরাহর প্রথম ওভারটাই মেডেন৷ মোহাম্মদ সিরাজের করা ইনিংসের চতুর্থ ওভার থেকেও রান পায়নি নিউজিল্যান্ড৷
শুরুর চার ওভারের দুটিই মেডেন৷ সঙ্গে ভয়ংকর ওপেনার ডেভন কনওয়ের উইকেট৷ পেসারদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে প্রথম ১০ ওভারে কিউইরা করেছিল ২ উইকেটে ৩৪ রান৷ টস জিতে টম ল্যাথামের দলকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানানোর সময় এমন স্বপ্নের শুরুর কথা ভাবেননি হয়ত রোহিত শর্মাও৷
চোটের জন্য কেন উইলিয়ামসন খেলতে পারেননি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটি৷ একই কারণে ছিলেন না ভারতীয় অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডে৷ তার জায়গায় বিশ্বকাপ অভিষেক হয়েছে সূর্যকুমার যাদবের৷ আর শার্দুল ঠাকুরের বদলে ভারতীয় একাদশে ফিরেছেন মোহাম্মদ সামি৷
ফেরার ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়ে ফেরাটা স্মরণীয় করেছেন সামি৷ সুনীল গাভাস্কার, রবি শাস্ত্রীর মত তারকারাও এজন্যই শুরু থেকে ফেরানোর আহবান জানাচ্ছিলেন সামিকে৷ প্রথম বলে উইকেটের পর ইনিংসে সবমিলিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে নিজের জাতটা আরও একবার চেনালেন সামি৷ বিশ্বকাপে তার উইকেট এখন ৩৬টি, যা ভারতীয়দের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ৷ পেছনে ফেলেন অনিল কুম্বলের ৩১ উইকেটের রেকর্ড৷ সমান ৪৪ উইকেট নিয়ে সামির সামনে কেবল জহির খান ও জাভাগাল শ্রীনাথ৷ তবে প্রথম ভারতীয় হিসাবে বিশ্বকাপে দুবার ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটা শুধুই সামির৷
২৭৩ রানের জবাবে ভারতের শুরুটা ছিল আক্রমণাত্মক৷ ১১ ওভারেই রোহিত শর্মা ও শুভমান গিল গড়েন ৭১ রানের জুটি৷ রেকর্ড গড়েছেন দুই ওপেনারই৷ ৩৮তম ইনিংসে ওয়ানডেতে দ্রুততম দুই হাজার রানের মাইলফলকে পা রেখেছেন গিল৷ ৪০তম ইনিংসে আগের রেকর্ডটা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার হাশিম আমলার৷ ওয়ানডেতে গিলের রান এখন দুই হাজার ১২৷
বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪০ ছক্কার রেকর্ডটা এখন রোহিতের৷ তিনি পেছনে ফেলেছেন ৩৭ ছক্কা মারা দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্সকে৷ ৪৯ ছক্কা নিয়ে রোহিতের সামনে কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল৷
শুরুটা ভালো করলেও রোহিত ও গিল দুজনই ফেরেন লকি ফার্গুসনের বলে৷ ৪০ বলে চার বাউন্ডারি ও চার ছক্কায় ৪৬ করা রোহিত হন বোল্ড৷ আর ৩১ বলে ২৬ করে গিল তালুবন্দি ডেরিল মিচেলের৷ দ্রুত দুই ওপেনারকে হারিয়ে চাপে পড়ে ভারত৷
১৬তম ওভারে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় খেলা৷ মেঘলা আকাশে বৃষ্টির জন্য নয়, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়া এই স্টেডিয়াম ছেয়ে যায় ঘন কুয়াশায়৷ ব্যাটার বা বোলার-কেউই দেখছিলেন না কিছু৷ আম্পায়াররা আলোচনা করে মাঠ ছাড়তে বলেন খেলোয়াড়দের৷ আর খেলা শুরু না হলে পরিত্যক্ত হত ম্যাচ৷ তবে দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবারও শুরু হয় খেলা৷
২২তম ওভারে ৩৩ করা শ্রেয়াস আয়ারকে ফিরিয়ে ভারতের চাপটা আরও বাড়ান ট্রেন্ট বোল্ট৷ তার শর্ট বলে পুল করতে যেয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে কনওয়ের দুর্দান্ত ক্যাচে পরিণত হন আয়ার৷ তবে বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুলের দৃঢ়তায় কাটে চাপটা৷
সেই চাপটা আবার ফিরে আসে লোকেশ রাহুল ২৭ করে মিচেল স্যান্টনারের বলে এলবিডাব্লিউ হওয়ার পর সূর্যকুমার যাদব ২ করে রান আউট হলে৷ ৩ উইকেটে ১৮২ থেকে ৫ উইকেটে ১৯১ রানে পরিণত হয় ভারত৷ তবে একটা প্রান্ত আগলে ভরসা হয়ে ছিলেন কোহলি৷ রবীন্দ্র জাদেজা তাকে সঙ্গ দিয়েছেন অপরাজিত ৩৯ রানের ইনিংসে৷
এর আগে টস জিতে বোলিং করা ভারতকে ব্রেক থ্রু এনে দেন মোহাম্মদ সিরাজ৷ তার চতুর্থ ওভারের তৃতীয় বলটা ফ্লিক করতে যেয়ে কোনো রান না করা কনওয়ে স্কয়ারে লেগে ক্যাচ তুলে দেন শ্রেয়াস আয়ারের হাতে৷
প্রথম চার ম্যাচে একাদশে জায়গা হয়নি মোহাম্মদ সামির৷ আজ শার্দুল ঠাকুরের বদলে সুযোগ পেয়ে প্রথম বলেই উইকেট নেন এই পেসার৷ সামির নবম ওভারের প্রথম বলটা কাট করতে যেয়ে স্টাম্পে টেনে এনে বোল্ড উইল ইয়ং৷ ২৭ বলে ১৭ করেন এই ওপেনার৷
নিজের তৃতীয় ওভারে রাচিন রবীন্দ্রর উইকেটটিও পেতে পারতেন সামি৷ কিন্তু বেকওয়ার্ড পয়েন্টে তার সহজ ক্যাচ ফেলেন রবীন্দ্র জাদেজা৷
তখন রাচিনের রান ছিল ১২৷ জীবন পাওয়া রাচিন ও মিচেল ভাঙেন বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে দেশের হয়ে যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ড৷ ১৯৭৯ বিশ্বকাপে ওপেনিংয়ে জন রাইট ও ব্রুশ এডগারের ১০০ রানের জুটি ছিল এতদিনের সেরা৷
আজ তৃতীয় উইকেটে সেটা পেছনে ফেলে রাচিন ও মিচেল গড়েন ১৫৯ রানের জুটি৷ রেকর্ড গড়ার পথে দুবার রিভিউ নিয়ে সফল হয়েছিলেন রাচিন৷ আর ৬০ রানে থাকার সময় জাদেজার বলে উইকেটের পেছনে লোকেশ রাহুল ক্যাচ ছাড়ায় জীবন পেয়েছিলেন মিচেল৷ ৬৯ রানে তিনি আবারও জীবন পান লংঅফে জাসপ্রিত বুমরাহর ক্যাচ মিসে৷
জুটিটা শেষ পর্যন্ত ভাঙেন সামি৷ তার স্লো অফকাটার ডাউন দ্য উইকেটে এসে ছক্কা মারতে যেয়ে রাচিন লং অনে ক্যাচ দেন শুভমান গিলকে৷ ৮৭ বলে ৬ বাউন্ডারি ১ ছক্কায় ৭৫ করেন রাচিন৷ মিচেল স্যান্টনার (১ রান) ও ম্যাট হেনরিকে বোল্ড করে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনাও জাগিয়েছিলেন তিনি৷
ডেরিল মিচেল করেন ক্যারিয়ারের পঞ্চম ওয়ানডে সেঞ্চুরি৷ ৩০তম ইনিংসে পঞ্চম ওয়ানডে সেঞ্চুরিটা নিউজিল্যান্ড ব্যাটারদের মধ্যে দ্বিতীয় দ্রুততম৷ ২২ ইনিংসে পঞ্চম সেঞ্চুরির রেকর্ডটা কনওয়ের৷ সেঞ্চুরিতে থেমে না থেকে মিচেল খেলেন ১২৭ বলে ৯ বাউন্ডারি ৫ ছক্কায় ১৩০ রানের ইনিংস, যা ওয়ানডেতে তার ক্যারিয়ার সেরা৷ সামির করা শেষ ওভারে ছক্কা মারতে যেয়ে বাউন্ডারি লাইনে বিরাট কোহলির তালুবন্দি হন মিচেল৷
ভারতীয় বোলারদের মধ্যে ১০ ওভারে সবচেয়ে বেশি ৭৩ রান খরচ কুলদিপ যাদবের৷ তবে নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক টম ল্যাথাম (৫ রান) ও গ্লেন ফিলিপসের (২৩ রান) উইকেট দুটি নিয়েছেন বাহাতি এই স্পিনার৷
৪০ ওভার শেষে নিউজিল্যান্ডের স্কোর ছিল ৪ উইকেটে ২১৯৷ সেখান থেকে স্কোরটা ৩০০ ছাড়িয়ে না যাওয়ার কৃতিত্বটা ভারতীয় বোলারদের, বিশেষ করে সামির৷ তার সুইংয়ে খেই হারিয়ে শেষ ১০ ওভারে ৫৪ রান তুলতে ৬ উইকেট হারায় কিউইরা৷ কোহলির বীরত্বের পরও ম্যাচ সেরার পুরস্কার তাই সামির৷
স্কোর
নিউজিল্যান্ড: ৫০ ওভারে ২৭৩/১০ (মিচেল ১৩০, রাচিন ৭৫, ফিলিপস ২৩; সামি ৫/৫৪, কুলদিপ ২/৭৩)
ভারত: ৪৮ ওভারে ২৭৪/৬ (কোহলি ৯৫, রোহিত ৪৬, জাদেজা ৩৯*; ফার্গুসন ২/৬৩, স্যান্টনার ১/৩৭)
ফল: ভারত ৪ উইকেটে জয়ী
ম্যাচ সেরা: মোহাম্মদ সামি