মানব-ঢাল কাণ্ড নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে
২৮ মে ২০১৭গত ৯ই এপ্রিল কাশ্মীরের বদগাও এলাকার সংসদীয় কেন্দ্রের উপ-নির্বাচনের সময় ভোটগ্রহণ পণ্ড করে দিতে যেভাবে স্থানীয় লোকজন চারদিক থেকে পাথর বৃষ্টি শুরু করে, তাতে ভোট কর্মী এবং আধা-সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা সমস্যা দেখা দেয়৷ ভোটকর্মীরা ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে যেতে ভয় পায়৷ পরিস্থিতি বুঝে সেনা অফিসার মেজর নিতিন লিতুল গগৈ পাথর ছোঁড়া দলে জড়িত সন্দেহে ফারুক আহমেদ দার নামে এক স্থানীয় বাসিন্দাকে সেনা জিপের বনেটে বেঁধে রাস্তায় নামে৷ উদ্দেশ্য যাতে পাথর বৃষ্টি প্রতিহত করা যায়৷ তাতে কাজও নাকি হয়৷ কিন্তু ফারুক আহমেদের বক্তব্য, তিনি পাথরবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না৷ যাচ্ছিলেন ভোট দিতে৷ তাঁকে এইভাবে লাঞ্ছিত করা অমানবিক৷ অপরদিকে সেনা অফিসার মেজর গগৈ-এর বক্তব্য, পাথর বৃষ্টির মোকাবিলা করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে হলে হতাহতের সংখ্যা বাড়তো বই কমতো না৷ তাই বিনা রক্তপাতে যাতে কাজ হাসিল করা যায়, সেই অনুযায়ী পরিস্থিতি বুঝে এটা করা হয়েছে৷ তবে জনঅসন্তোষের প্রেক্ষিতে, সেনাবাহিনী এবং জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ আলাদাভাবে এই ঘটনার পৃথক পৃথক তদন্ত শুরু করেছে৷
তবুও বিতর্ক থেমে থাকেনি৷ কিন্তু গোল বেঁধেছে আরও, যখন মেজর গগৈকে সহিংসতার মোকাবিলায় প্রশংসনীয় কাজের জন্য দেওয়া হয় সেনাপ্রধানের প্রশংসাপত্র৷ জোরালো প্রশ্ন উঠেছে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই প্রশংসাপত্র দেবার যৌক্তিকতা কী? যাঁর তিরস্কার প্রাপ্য তাঁকে দেওয়া হয় পুরস্কার? ফলে এর মানবিকতা, নৈতিকতা, অনৈতিকতা, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে৷
নাগরিক তথা বিদ্দ্বজন সমাজ স্পষ্টতই বিভাজিত৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে নানা রকম মন্তব্য৷ তবে বলিউড অভিনেতা এবং বিজেপি সাংসদ পরেশ রাওয়ালের টুইট যেন আগুনে ঘি ঢেলেছে৷ বিখ্যাত লেখিকা ও সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায়কে নিশানা করে তিনি বলেছেন, ‘‘কাশ্মীরে বিক্ষোভকারীর বদলে সেনা জিপে বেঁধে ঘোরানো উচিত ছিল অরুন্ধতী রায়কে, কেননা, তিনি হামেশাই কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষে কথা বলে থাকেন৷ রাজ্যে অশান্তির জন্য সমালোচনা করে থাকেন নিরাপত্তা বাহিনীর৷''
এই মন্তব্যের জেরে বিতর্ক আরও দানা বেঁধেছে৷ সরব হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলিও৷ পরেশ রাওয়ালের মন্তব্যকে সমর্থন করেছে বিজেপি এবং সংঘ-পরিবার৷ কংগ্রেস সমালোচনা করেছে বেশ সাবধানে, কারণ, এখানে সেনাবাহিনী জড়িত৷ তাই রেখে-ঢেকে বলেছে, কাকে পুরস্কার দেওয়া হবে-না-হবে সেটা সেনাবাহিনীর নিজস্ব ব্যাপার৷ তবে শাসকদল বিজেপি যে ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না, সেটা স্পষ্ট৷ সিপিএম মানব-ঢাল ব্যবহার এবং সেজন্য সংশ্লিষ্ট সেনা অফিসার মেজর গগৈকে শংসাপত্র দেবার সমালোচনা করেছে৷
বিদ্বজ্জন তথা নাগরিক সমাজে উঠেছে দুটি বড় প্রশ্ন৷ প্রথমটি – প্রশংসাপত্র দেবার এটাই কি ছিল সঠিক সময়? তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ পর্যন্ত কি অপেক্ষা করা যেত না? এর ফলে তদন্ত প্রক্রিয়ার উপর মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা আর থাকে না৷ হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাবাহিনীকে জঙ্গিদের মোকাবিলা করতে হয়৷ এটা মেনে নিয়েও বলা যায়, উর্দিধারীদেরও একটা ন্যূনতম মৌলিক আচরণবিধি পালন করতে হয়৷ যেমনটা রেডক্রসের ক্ষেত্রে করা হয় সেটা লঙ্ঘন করা কাজের কথা নয়, বরং আন্তর্জাতিক আইনেরও খেলাপ৷ জেনেভা কনভেনশনে মানব-ঢাল ব্যবহার করা যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য৷ দেশের ভেতরে এটার গায়ে জাতীয়তাবাদের তকমা দেওয়াও ঠিক নয়৷
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের সমাজবিদ দেবদাস ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে বললেন, এটা খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা সন্দেহ নেই৷ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বলতে পারি, ভেবে দেখা দরকার কেন এই বেদনাদায়ক পরিস্থিতির উদ্ভব হলো? পাঁচ-ছয় বছর আগে মনে আছে জম্মু-কাশ্মীরে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল৷ তাতে ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছিল সহিংসতা ছাড়াই৷ তাহলে কথা হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতি রাজ্যে এতটা খারাপ হলো কেন? সেদিকে সরকারের নজর দেওয়া দরকার সব থেকে বেশি৷ পরিস্থিতি সামলাবার একটা কার্যকর ম্যানেজমেন্ট দরকার৷ মেজর গগৈ-এর সামনে কী পরিস্থিতি ছিল ঠিক জানি না৷ তবে মেজর গগৈকে আলাদাভাবে পুরস্কার দেবার যুক্তিটা ঠিক বোধগম্য নয়৷ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেই তো তাঁদের ঐ রাজ্যে পাঠানো হয়েছে৷
পাশাপাশি নাগরিক সমাজের একাংশের মতে, যাঁরা এটাকে অমানবিক বলছেন তাঁরা কি বলবেন সেনাবাহিনীর ওপর পাথর বৃষ্টি করা, পেট্রল বোমা ছোঁড়া, পুলিশ চৌকি আর স্কুল জ্বালিয়ে দেওয়া কতটা মানবিক? নিরাপত্তা বাহিনী দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় প্রাণ হাতে নিয়ে ২৪ ঘন্টা জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করছেন তাঁরা মানুষ নন? মেজর লিতুল গগৈ রক্তপাত এড়াতে যা করেছেন, তুলনামূলকভাবে সেটা কি বেশি মানবিক নয়?
উল্লেখ্য, গত ৯ই এপ্রিল কাশ্মীরে মানব-ঢাল কাণ্ড এবং মেজর গগৈকে পুরস্কৃত করা নিয়ে দুটি পৃথক আর্জির শুনানি করবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশন৷ প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সইফুদ্দিন সোজ বলেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য গত ২৪শে মে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে তিনি যে অভিযোগ করেছিলেন, তার প্রেক্ষিতে, সংশ্লিষ্ট সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে কমিশন কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চান৷
অনুরুপ আর্জি জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক জাস্টিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস ফোরামের চেয়ারম্যান আবসান উন্টু৷ ফারুক আহমেদ দারকে পাথর ছোঁড়া ব্যক্তি বলে যে তিনটি টিভি চ্যানেল মিথ্যা প্রচার করেছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দাবি জানিয়েছেন তিনি৷
অন্যদিকে মেজর গগৈকে পুরস্কৃত করায় ডিব্রুগড় জেলার ছোট শহর নামরুপের ঘরের ছেলে লিতুলের মা-বাবাকে সম্বর্ধনা দিলেন স্থানীয় বিজেপি সাংসদ রামেশ্বর তেলি৷ পরিবারে আনন্দের ধুম৷
বন্ধু, মেজর গগৈকে পুরস্কৃত করাকে কি আপনি সমর্থন করেন? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷