কাশ্মীর নিয়ে ভারতের কূটনৈতিক একগুঁয়েমি
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০চিড়িয়াখানায় নতুন কোনও পশু-পাখি এলে অথবা বিশেষ কোনও সৌন্দর্যায়ন হলে বিজ্ঞাপন করা হয়। টিকিট কেটে কর্তৃপক্ষের দেখানো রাস্তায় হেঁটে দর্শককে উপভোগ করতে হয় সেই দৃশ্য। কখনও কখনও বিশিষ্ট মানুষদেরও আহ্বান জানানো হয়। বিনামূল্যে কর্তৃপক্ষ তাঁদের চিড়িয়াখানা ঘুরিয়ে দেখান। কিন্তু তারই মধ্যে কেউ যদি সেই পথ থেকে সামান্য সরে গিয়ে পশু অধিকারের বেমক্কা প্রশ্ন তোলেন, জানতে চান, খাঁচায় বন্দি পশু-পাখিদের পুষ্টির কথা, যাপনের কথা, তখন একটা সহজ রাস্তা নেন চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়া হয় ওই ব্যক্তিকে। ওই ব্যক্তি যাতে আর কখনও চিড়িয়াখানায় ঢুকতেই না পারেন, তার ব্যবস্থা করা হয়। কাশ্মীর নিয়ে ভারতের নীতি এখন অনেকটা তেমনই।
বিশ্বের কাছে ভারত প্রমাণ করতে চাইছে উপত্যকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক। শান্ত। নিরুপদ্রব। দেশ বিদেশের রাষ্ট্রদূতদের দফায় দফায় কন্ডাকটেড ট্রিপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাজোয়া গাড়ির কনভয় সাজিয়ে তাদের দেখানো হচ্ছে মহল্লা, বাজার, রাস্তাঘাট। আপাত ভাবে কাশ্মীর সত্যিই শান্ত। অতীতে কাশ্মীর যে অশান্তি দেখেছে, ইদানীং তা যে খুব দেখা যাচ্ছে, এমন নয়। কিন্তু ভিতরে ভিতরে আগুন যে জ্বলছে, তা বুঝতেও খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হয় না। সমস্যা হল, সে কথা কেউ বলতে গেলেই নেমে আসছে শাস্তির খাঁড়া। সকলকে সরকারের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হতে হবে। এটাই চাইছে রাষ্ট্র। উল্টো কথা বললেই বিপদ।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের এক সাংসদকে দিল্লি বিমান বন্দর থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে ভারতে আসছিলেন ওই লেবার পার্টির সাংসদ। সঙ্গে ছিল ভারত সরকারেরই দেওয়া বৈধ ভিসা। কিন্তু বিমানবন্দরে নেমে তিনি জানতে পারেন ভিসাটি বাতিল হয়ে গিয়েছে। অভিবাসন দফতর সে কথা জানিয়ে তাঁকে তুলে দেয় ফিরতি বিমানে। কারণ সহজ, বিলেতের পার্লামেন্টে কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন তিনি। প্রশ্ন তুলেছিলেন মানবাধিকারের। ভারত সরকার কাশ্মীরকে যে ভাবে মরুদ্যান হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। অভিযোগ, সে জন্যই এই শাস্তি।
যুক্তরাজ্যের এক কেউকেটা সাংসদের সঙ্গে যদি এ ঘটনা ঘটতে পারে, তাহলে দেশের ভিতরে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কী ঘটছে তা সহজেই অনুমেয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কী ভাবে বেঁচে আছেন কাশ্মীরের মানুষ। বিরোধীদের বক্তব্য, কাশ্মীরে যে শান্তি পরিস্থিতি দেখানোর চেষ্টা করছে সরকার, তা আসলে কার্ফু, জলপাই উর্দি, বন্দুকের নল আর পেলেট গানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ঝড়ের আগের নীরবতা।
ফেরা যাক সাম্প্রতিক অতীতে। গত ৫ অগাস্ট জম্মু কাশ্মীর রাজ্যটিকে ভেঙে দু'টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। আর বাতিল করা হয় উপত্যকার বিশেষ অধিকার। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদে কাশ্মীরকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কেন দেওয়া হয়েছিল? ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে মহারাজা হরি সিং এর স্বাধীন রাজ্য কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন চুক্তি সই হয়েছিল। ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতার পরে কাশ্মীর কার থাকবে তা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়েছিল ভারত এবং পাকিস্তানের। প্রাথমিক ভাবে কোনও দেশেই যেতে চাননি হরি সিং এবং কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। কিন্তু পাকিস্তান থেকে নির্দিষ্ট কিছু জনজাতির যোদ্ধা এবং তার পিছনে পাকিস্তান ফৌজ কাশ্মীর দখল করতে ঢুকে পড়লে ভারতের কাছে সাহায্য চান হরি সিং। কাশ্মীরে প্রবেশ করে ভারতীয় সেনাও। আর সেই পরিস্থিতিতেই সই হয় ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন। ভারতের আরও বহু স্বাধীন রাজ্যের সঙ্গেও এই একই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কাশ্মীরের সঙ্গে চুক্তিতে হরি সিং স্পষ্ট করেই বলেছিলেন কোন কোন বিষয়ে কাশ্মীর ভারতের কাছে অনুগত থাকবে এবং কোন কোন বিষয়ে থাকবে না। কাশ্মীরের আলাদা সংবিধানের প্রস্তাব সেখানেই দেওয়া ছিল। এবং তারই জের ধরে ভারতীয় সংবিধানে কাশ্মীরের জন্য আলাদা একটি অনুচ্ছেদ তৈরি হয়েছিল, ৩৭০। কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা। একই সঙ্গে বলা হয়েছিল অনুচ্ছেদটি সাময়িক। প্রয়োজন ফুরোলে অনুচ্ছেদটি বাতিল করা হবে। প্রয়োজন ফুরিয়েছিল কি না, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক। বছর কয়েক আগেও একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল ৩৭০ অনুচ্ছেদ এখনও প্রাসঙ্গিক।
তবে প্রশ্ন অন্য। গত ৭০ বছরে ৩৭০ অনুচ্ছেদের জন্য কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ সত্যিই কি প্রচুর সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন? উত্তর এক কথায় দেওয়া যায় না। সুবিধা যেমন মিলেছে, অসুবিধাও হয়েছে বিস্তর। বস্তুত গত ৭০ বছরে ৩৭০ অনুচ্ছেদেও বহু পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন হয়েছে। জম্মু কাশ্মীর বিধানসভার সম্মতিতেই তা ঘটেছে। তবে এত কিছু সত্ত্বেও ৩৭০ অনুচ্ছেদ ছিল কাশ্মীরের মানুষের কাছে এক ধরনের সম্মান। নিঃশেষ হয়ে যাওয়া জমিদার বাড়ির শেষ ঝাড়বাতিটার মতো।
স্বাধীনতার পর্ব থেকেই কাশ্মীরে বার বার গণভোটের দাবি উঠেছে। উপত্যকার মানুষ সে দাবি করেছেন, মহাত্মা গান্ধী সে দাবি তুলেছেন, এমনকী, জাতি সংঘও একাধিকবার সে কথা বলেছে। কিন্তু ৭০ বছর ধরে ভারত এবং পাকিস্তানের সরকার তার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি। দীর্ঘ দিন ধরে কাশ্মীরের মানুষ এই বঞ্চনা সয়ে এসেছেন। ৩৭০ অনুচ্ছেদ ছিল তাঁদের কাছে শেষ রক্ষাকবচ। ভারত সরকার যে কায়দায় তা তুলে দিয়েছে তা নিয়ে নানা মুনির নানা অভিমত। সাংবিধানিক সে সব প্রশ্ন সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালত বিচার করবে। কিন্তু মনবতা?
ভারত সরকারের দাবি, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পরেও কাশ্মীর উপত্যকায় কোনও অশান্তি হয়নি। সেখানে সব কিছু স্বাভাবিক। অথচ অগাস্টের পর থেকে দীর্ঘ দিন কাশ্মীর উপত্যকা সাধারণ মানুষের জন্য কার্যত বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। দিনের পর দিন সেখানে জারি ছিল কার্ফু। কাশ্মীর শান্ত রাখার জন্য কয়েক হাজার অতিরিক্ত সেনা এবং আধা সেনা পাঠানো হয়েছিল সেখানে। তারা এখনও সেখানে মজুত। গ্রেফতার করা হয়েছে উপত্যকার প্রাক্তন তিন মুখ্যমন্ত্রীকে। গত প্রায় ছ'মাস ইন্টারনেট পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এখন খাতায় কলমে ইন্টারনেট মিললেও লোকে বলছেন, বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। বহু সংবাদপত্র বন্ধ। বাকি সংবাদপত্রের দফতর টিমটিম করে খোলা। ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। হাসপাতালে কার্যত কাজ হচ্ছে না কারণ, ইন্টারনেট না থাকায় যন্ত্রপাতি আপডেট করা যাচ্ছে না। বিরোধীদের বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদীর 'ডিজিটাল ইন্ডিয়ায়' এই হল একটি রাজ্যের সার্বিক চিত্র। সরকার বলছে, গত অগাস্টের পর থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় একটিও গুলি চলেনি। অথচ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি বলছে, হাসপাতাল ভরে গিয়েছে আহত মানুষের ভিড়ে। বাদ নেই শিশুরাও। কোনও রকম প্রতিবাদ করতে হলেই বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে খর্বিত হচ্ছে মৌলিক অধিকার।
গত ৭০ বছর ধরে বহু ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়েছে কাশ্মীর। অতীত সরকারগুলির বিরুদ্ধে মানবতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে বার বার। বলা হয়েছে, গণতন্ত্র রক্ষিত হচ্ছে না উপত্যকায়। আবার একই সঙ্গে আন্দোলনের নামে মৌলবাদী হিংসার চিত্রও দেখেছে কাশ্মীর। দেখেছে সন্ত্রাসবাদীদের তাণ্ডব। ঘটেছে পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণ। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ অবস্থা বিচরণ করেছে দিনের পর দিন। আক্রান্ত হয়েছে মানবতা। গ্রামের পর গ্রাম পরিণত হয়েছে হাফ উইডো বা অর্ধ বিধবায়। যে মহিলারা জানেনই না তাঁদের স্বামীরা আদৌ বেঁচে আছেন কি না। গত এক-দেড় দশকে সেই পরিস্থিতির খানিক বদল ঘটতে শুরু করেছিল। শান্ত হচ্ছিল কাশ্মীর। জঙ্গি আন্দোলনের পরিমাণ কমছিল। খুলছিল আলোচনার রাস্তা। বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল সেই চিত্রটা ফের বদলে দিয়েছে। ভারত সরকার খুব ভাল ভাবেই বুঝতে পারছে বিষয়টি। মুখে যা-ই বলুক, সরকার, প্রশাসন বুঝতে পারছে কাশ্মীরের পরিস্থিতি সুবিধের নয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাই বিষয়টি নিয়ে কথাই বলতে চাইছে না সরকার। শুনতে চাইছে না সমালোচনাও। বার বার বলা হচ্ছে বিষয়টি একান্তই ভারতের অভ্যন্তরীণ।
কূটনৈতিক ভাবে ভারত কাশ্মীর সমস্য়া অভ্যন্তরীণ বলে দেখাতেই পারে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, মানবাধিকারের কোনও দেশ হয় না। তা আক্রান্ত হলে প্রশ্ন উঠবেই। সীমান্তের ভিতরে উঠবে, বাইরেও উঠবে। কাশ্মীর নিয়ে সেই প্রশ্নগুলোই উঠছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সরকার সমালোচনা গ্রহণ করে। অন্তত কূটনৈতিক স্বার্থে তার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। খর্গহস্ত হয় না। বরং বিশ্বের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা করে ক্ষতের নিরাময় হচ্ছে। কাশ্মীর নিয়ে বর্তমান ভারত সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে ক্ষত নিরাময় হচ্ছে না। বরং ক্ষত বাড়ছে। সোজা বাংলায় একে একগুঁয়েমি বলে। কূটনীতি যখন একগুঁয়েমি হয়ে যায়, ইতিহাস বলে তার ফল ভালো হয় না। ভারতে কী হবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে।