কাশ্মীর উপত্যকায় বন্যা
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বা সিএসই-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চরম আবহাওয়ার এক বিধ্বংসী রূপ এই বন্যা৷ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নজীরহীন বৃষ্টিপাত, জল নিকাশি ব্যবস্থাপনার গলদ, পরিকল্পনাহীন নগরায়ন এবং বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাব – সংবাদমাধ্যমকে এ কথাই বলেছেন সিএসই-এর মহাপরিচালক সুনীত নারায়ন৷
তিনি বলেন, কাশ্মীর উপত্যকায় এর আগেও বন্যা হয়েছে৷ কিন্তু আগের তুলনায় এবার জম্মু-কাশ্মীরের বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবার কারণ পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন, বিশেষ করে নদী উপকূলে৷ গত ১০ বছরে শ্রীনগরের ৫০ শতাংশেরও বেশি লেক, পুকুর ও জলাভূমি অবৈধভাবে দখল করে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট বানানো হয়েছে৷ এর থেকে বাদ যায়নি ঝিলাম নদীর উপকূল এলাকাও৷ ফলে নদীখাদের জল নিকাশি ক্ষমতা কমে গেছে৷ স্বভাবতই ঐ সব এলাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবথেকে বেশি৷
বিজ্ঞান ও পরিবেশ গবেষণা কেন্দ্রের কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, এই ধরণের বন্যা বিপর্যয়ের মোকাবিলা করার জন্য তৈরি ছিল না জম্মু-কাশ্মীর সরকার৷ ছিল না বন্যার আগাম সতর্কতা জারি করার কোনো ব্যবস্থা৷ বন্যার পূর্বাভাষ দেবার জন্য তিনি জাতীয় ‘অ্যাকশন প্লানের' প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন৷ বলেন, কাশ্মীরের বিধ্বংসী বন্যা আবারো মনে করিয়ে দিল যে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ভারতে কত ভয়ংকর হতে পারে৷
গত ১০ বছরে প্রবল বর্ষণ ভারতে বিপর্যয় ঘটিয়েছে বহুবার৷ জম্মু-কাশ্মীরের ভয়াবহ বন্যা তার সাম্প্রতিকতম সংযোজন৷ সিএসই-এর উপ-মহাপরিচালক চন্দ্রভূষণ বলেন, গবেষকরা এই ধরণের দুর্যোগের একটা তালিকা তৈরি করেছেন৷ তাতে রয়েছে ২০০৫ সালে মুম্বই-এর বন্যা, ২০১০ সালে লাদাকের লেহ শহরের হড়পা বান এবং ২০১৩ সালে হিমালয় রাজ্য উত্তরাখণ্ডের বন্যা ও ভূমিধস৷ তাই সরকারের উচিত সব উন্নয়ন নীতি ও কর্মসূচিতে জলবায়ু পরিবর্তনের ইস্যুটিকে অগ্রাধিকার দেয়া৷ শহরের পরিকাঠামো থেকে কৃষি, জল সরবরাহ থেকে এনার্জি পরিকাঠামো নির্মাণের সময় জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের কথা মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি৷ অন্যথায় এই ধরণের বিপর্যয়ে মারা যাবে হাজার হাজার মানুষ, ক্ষতি হবে হাজার হাজার কোটি টাকা৷ কাশ্মীর উপত্যকায় অসময়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুণ বন্যা পরিস্থিতি এতটা খারাপ হয়েছে৷ অনেক জায়গায় গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ২০০ মিলিমিটার, মাসিক গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে যা প্রায় ৪০০ শতাংশ বেশি৷
ভারতের কেন্দ্রীয় আবহ বিভাগ কিন্তু মুম্বই, লেহ, উত্তরাখণ্ড ও জম্মু-কাশ্মীরে বন্যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে কারণ বলে মনে করেনি৷ বিজ্ঞান ও পরিবেশ গবেষণা সংস্থার বলেছে, সরকারের পরিবেশ, অরণ্য ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ও নাকি এ ধরণের বন্যা বিপর্যয়ের কারণ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি৷ বেশিরভাগ জলবায়ু পরিবর্তন সমীক্ষায় পূর্বাভাষ দেয়া হয়েছে যে, আগামী দশকগুলিতে বিশ্বে উষ্ণায়নের মাত্রা বাড়তে থাকবে আর বৃষ্টি ও বন্যার মতো ঘটনার আঘাত ভারতের ওপর হবে তীব্রতর৷ এর প্রতিকার হিসেবে সিএসই-এর সুপারিশ – বৃষ্টির পূর্বাভাষ, আগাম সতর্কতা জারি, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী শক্তিশালী করা, এবং স্থানীয় ও রাজ্যস্তরে জলবায়ু গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো ইত্যাদি৷
পাশাপাশি কাশ্মীরের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক টানাপোড়েন৷ কেউ কেউ মনে করেন, মোদীর চটজলতি কাশ্মীরে যাওয়া এবং ১০০০ কোটি টাকা প্যাকেজ সাহায্য ঘোষণার পেছনে কাজ করেছে কাশ্মীর বিধানসভার আসন্ন নির্বাচন৷ সেটা মেনে নিলেও একথা অনস্বীকার্য, মোদী সরকার যেভাবে দ্রুতগতি কাশ্মীরের বন্যা পরিস্থিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে৷ বন্যাত্রাণ সাহায্য নিয়ে তড়িঘড়ি নেমে পড়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিও৷ তবে ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে গাফিলতির অভিযোগে কাশ্মীরের ওমর আবদুল্লা সরকার পড়েছে তীব্র জনরোষের মুখে৷ ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনী অবশ্য অবিরাম ত্রাণ ও উদ্ধার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, যা কাশ্মীরিদের মন থেকে সেনাবাহিনীর নেতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও হয়ত দূর করতে সক্ষম হবে৷
কাশ্মীর উপত্যকায় ইতিমধ্যেই মোতায়েন করা হয়েছে ৩০ হাজার সেনাকর্মী এবং ৮০টি ভারি মালবাহী বিমান ও হেলিকপ্টার৷ ব্যাপকভাবে বিতরণ করা হচ্ছে জলের বোতল, খাবার প্যাকেট, বেবিফুড, তাঁবু এবং কম্বল৷ পাঠানো হয়েছে ৭০টি আর্মি মেডিকেল টিম৷ শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৭ হাজার মানুষকে৷ কিন্তু এখনও জলবন্দি হয়ে রয়েছেন আরো প্রায় লাখ খানেক মানুষ, যাঁদের মধ্যে আছেন ৯ জন জার্মান পর্যটক৷