অর্থ পাচার: ভারতের বিরাট সমস্যা
২৩ মে ২০১৭বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ফি-বছর ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা সবার অলক্ষ্যে বিদেশে যাচ্ছে৷ বিগত তিন বছর দেশের শাসনভার মাথায় তুলে নিয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার৷ কয়েকটি পদক্ষেপও নিয়েছে৷ কিন্তু বলা বাহুল্য, কোনো পদক্ষেপই দেশের জন্য উপযুক্ত প্রমাণিত হয়নি৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সবটাই রাজনৈতিক গিমিক৷ কালোটাকা, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদি নির্মূল করার কথা বলে গতবছর ৮ নভেম্বর রাতে আচমকা দূরদর্শনের মাধ্যমে দেশের সমস্ত পুরোনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী৷ তবে পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত না নেওয়ায় সিদ্ধান্তটি মুখ থুবড়ে পড়ে৷ সরকারের পাশাপাশি সার্বজনীন সিদ্ধান্ত হলে যা হতে পারত, তা হয়নি৷ সফলতা বড়জোর ১০ শতাংশ৷ তার মানে, কালোটাকা নির্মূল হয়নি৷
আদৌ কি তা সম্ভব?
‘কালোটাকা' মানে কী? গত কয়েক দশক ধরে ভারতে যা নিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক,সেই ‘কালোটাকা'র মানে বোঝেন এমন লোকের সংখ্যা নেহাৎই কম বলা চলে৷ সরকারি মতে এবং আর্থিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, দেশে বা বিদেশে ভারতীয় নাগরিকদের জমা থাকা যে টাকার আয়ের উৎস সরকারকে জানানো হয়নি, তাই আসলে কালোটাকা৷ আরও স্পষ্ট করে বললে, যে টাকার আয়কর দেওয়া হয়নি, তাই কালোটাকা৷ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা তাই দুশ্চিন্তার কারণ৷
শুধুমাত্র ২০১৪ সালেই ভারত থেকে ২১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ‘কালোটাকা' বিদেশে পাচার হয়েছে৷ সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক নজরদারি সংস্থা ‘গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি' (জিএফআই) তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে এই তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে৷ তা দেখে ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের ‘চক্ষু চড়কগাছ'৷ ২০১৪ সালের এই হিসেব তার আগের বছরের রেকর্ডও গুঁড়িয়ে দিয়েছে৷ ২০১৩ সালের তুলনায় ভারত থেকে প্রায় ১৯ শতাংশ বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে৷ বহু জটিল সমীক্ষার মাধ্যমে তৈরি হওয়া ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, শুধু ভারত নয়, ২০০৫ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত গোটা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির মোট বার্ষিক বাণিজ্যিক লেনদের ১৪ থেকে ২৪ শতাংশই অবৈধ ছিল৷
প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়েছে, বাণিজ্যিক দুর্নীতির ওপর ভর করে ৬২০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৯৭০ বিলিয়ন ডলার ঘুরপথে পাচার হয়ে গেছে৷ জিএফআই-র রিপোর্টে এই প্রথম ভারতে যে পরিমাণ বেআইনি অর্থ ঢুকছে, তার তথ্যও দেওয়া হয়েছে৷ টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার পাশাপাশি অবৈধ অর্থের এই জোগানও অর্থনীতির পক্ষে চরম ক্ষতিকারক৷ জিএফআই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪ সালে প্রায় ১০১ বিলিয়ন ডলার বেআইনি অর্থ ভারতে এসেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি৷ রিপোর্টে সমগ্র বিশ্বে অর্থের বেআইনি পাচারের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে৷ এ ধরণের অবৈধ কারবার আটকাতে রিপোর্টে সুপ্রশিক্ষিত আয়কর আধিকারিক নিয়োগ, বাণিজ্য চুক্তির কঠোর পরীক্ষার পাশাপাশি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ে ট্যাক্স ছাড়ের স্বর্গরাজ্য-দেশগুলি সহ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা গড়ে তোলার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে৷
‘দীপালি ইন্টারন্যাশনাল লিবারেল ফিলানথ্রোপিক সিটিজেনস ফোরাম'-এর কর্ণধার মনোরঞ্জন মাইতি দীর্ঘদিন ধরে আয়কর নিয়ে কাজ করছেন৷ সদ্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গড়ে বেআইনি লেনদেনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘ভারতের রাজনৈতিক নেতা এবং আইন প্রণেতাদের বড় একটা অংশই কালোটাকার জন্মদাতাদের লালন-পালন করেন৷ কালোটাকার নামে গরিব মানুষকে বোকা বানিয়ে ভোটের রাজনীতি করা দেশের মজ্জায় ঢুকে গেছে৷ কোনোদিন যদি সংবিধান সংশোধন করা যায়, তবেই এর সমাধান সম্ভব, নচেৎ কখনওই নয়৷''
এদিকে, দেশজুড়ে কালোটাকার রমরমা চলছেই৷ নোট বাতিল নিয়ে যা ভাবা হয়েছিল, তেমনটা ঘটেনি৷ নোট বাতিলের সিদ্ধান্তেও আটকানো যায়নি ভোটে কালো টাকার খেলা৷ সম্প্রতি এই কথা স্বীকার করে নিয়েছেন জাতীয় মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নাসিম জাইদি৷ কালোটাকার গাছ উপড়ে আনার কথা বলেছিলেন মোদী৷ এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, নোট বাতিল এবং ‘গোপন আয় ঘোষণা স্কিম' কালোটাকার মালিকদের ওপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি৷ বেশিরভাগ কালোটাকার মালিকরা একাধিক বেনামি অ্যাকাউন্ট এবং ‘প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা'-র সাহায্য নিয়ে নূন্যতম আর্থিক ক্ষতি ও সামান্য ‘শাস্তি'-র সম্মুখীন হয়ে তাদের টাকা গচ্ছিত রাখার সুযোগ পেয়ে যাবে, এই সম্ভাবনাই প্রবল৷ দেশের অর্থ ব্যবস্থায় থাকা মোট কালোটাকার পরিমাণ প্রায় এক লক্ষ কোটি হলেও এখন পর্যন্ত পিএমজিকেওয়াই প্রকল্পে মাত্র ২৩০০ কোটির হদিশ পেয়েছে সরকার৷
আয়কর দপ্তরের দাবি, তারা মোট ১৮ লক্ষ এমন লোকের সন্ধান পেয়েছে যাদের আমানতের সঙ্গে আয়কর হিসেবের সামঞ্জস্য নেই৷
সরকারের প্রাথমিক ভাবনা ছিল, নোট বাতিলের জেরে সব টাকা ব্যাংক পর্যন্ত পৌছাবে না৷ কালোটাকার মালিকরা জব্দ হবে৷ বিপুল পরিমাণ টাকা অর্থ ব্যবস্থার বাইরে থেকে যাবে৷ যাতে সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাংক একদিকে যেমন অনেকটা দায়মুক্ত হবে, তেমনই দেশের অর্থনীতিকে বেশ কিছুটা চাঙ্গা করা সম্ভব হবে৷ কিন্তু এই প্রত্যাশায় জল ঢালা হয়ে গেল যখন, প্রায় সমস্ত টাকাই ব্যাংকগুলির কাউন্টারে এসে জমা পড়ল৷
দুর্নীতি উৎখাত হয়েছে? প্রথমত, সমস্ত দুর্নীতি নগদে হয় না৷ দ্বিতীয়ত, যদি শুধুমাত্র নগদেই দুর্নীতির লেনদেন হয়, তবে, সেটা নতুন নোটেও সম্ভব৷ নোট বাতিলের পরেও নগদে ঘুস নিতে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ধরা পড়ার ঘটনা ঘটেছে৷ কেনিয়ায় মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশই প্রাপ্তবয়স্ক৷ সেদেশের বেশিরভাগ মানুষ আর্থিক লেনদেনের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন৷ দেখা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বের ১৬৮টি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৩৯ নম্বরে স্থানে রয়েছে কেনিয়া৷
অন্যদিকে, জঙ্গি কার্যকলাপ নির্মূল হওয়া তো দূর, ইদানীং একের পর জঙ্গি হামলায় জেরবার হচ্ছে সরকার৷ নোট বাতিলের পর খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য দাবি করেছেন, পুরোনো ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের ফলে টাকার জোগান কমে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন রাজ্যে মাওবাদী এবং কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে৷ অথচ এরপরও সেনা জওয়ানদের ওপর মাওবাদী হামলার ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ একইসঙ্গে কাশ্মীরে জওয়ানদের ওপর পাথর ছোঁড়ার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷
এত সবের পর বাকি থাকে ‘ক্যাশলেস' অর্থ ব্যবস্থা৷ নোট বাতিলের মাধ্যমে দেশের অর্থ ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলের অধীনে স্বাভাবিক দিশার দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছে সরকার৷ ব্যাংকগুলিতে আরও অনেক বেশি সংখ্যক আমানতকারীর সন্ধান পেতে সক্ষম হয়েছে আয়কর দপ্তর৷ তাছাড়া নোট বাতিল পরবর্তী সময়ে সরকারের ক্যাশলেস অর্থ ব্যবস্থায় জোর দেওয়ার উদ্যোগ দেশের একটা বড় অংশকে ডিজিটাল লেনদেনের দিকে আকৃষ্ট করেছিল৷ ‘ভীম' অ্যাপ চালু করা এবং ডিজিটাল লেনদেনে পুরস্কার ঘোষণা করে বহু মানুষকে ‘ক্যাশলেস' লেনদেনে উৎসাহ জুগিয়েছে সরকার৷ কিন্তু যখনই ‘রিমনিটাইজেশন', অর্থাৎ বাজারে আবার নোটের জোগান স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে, তখনই আবার দ্রুত ‘ক্যাশলেস' অর্থব্যবস্থায় ধস লক্ষ্য করা গেছে৷ আম জনতার মধ্যে এটিএম থেকে টাকা তোলার হিড়িকও পুরোনো ছন্দে ফিরে এসেছে৷
আয়কর দপ্তরের তথ্য বলছে, নভেম্বরেরনোট বাতিলের পর থেকে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২,৩৬২টি জায়গায় তল্লাশি হয়েছে৷ ৮১৮ কোটি টাকার সম্পত্তি আটক করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬২২ কোটি টাকা নগদ৷ কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে ৯,৩৩৪ কোটি টাকা চিহ্নিত হয়েছে৷ ৪০০টি মামলার তদন্ত শুরু করেছে ইডি ও সিবিআই৷ এবার দ্বিতীয় দফায় যারা পুরনো নোটে ৫ থেকে ১০ লক্ষ টাকা জমা করেছেন, তাঁদের ঠিকুজিকোষ্ঠীর তদন্ত শুরু হচ্ছে৷ শুক্রবারই মুম্বইয়ে কেন্দ্রীয় আয়কর পর্ষদের শীর্ষকর্তারা বৈঠকে বসছেন৷ সূত্রের খবর, নোট বাতিলের পর ব্যাংকগুলিতে বাতিল নোট জমা পড়ার সমস্ত নথি আতসকাচের তলায় ফেলা হবে৷ আয়কর দপ্তরের এক কর্তা ডয়েচে ভেলকে জানিয়েছেন, ‘‘নোট বাতিলের পর যেসব কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ১২ দশমিক ৫ লক্ষ টাকার বেশি জমা পড়েছিল, তার সম্পর্কে ব্যাঙ্কগুলিকে নথি দিতে বলা হয়েছিল৷ এতদিন ‘ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট' থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তল্লাশি হয়েছে৷ আর এবার ব্যাংকের নথির ভিত্তিতে যারা পুরনো নোট জমা করেছেন, সেই টাকার সঙ্গে তাঁদের আয়, কর জমার পরিমাণ মিলিয়ে দেখা হবে৷ অন্যের অ্যাকাউন্টে জমা করা টাকা বেনামি লেনদেন আইনে তদন্ত হবে৷
এতকিছুর পরেও ভারতের ব্যাংকগুলি থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ নিয়ে বিদেশের মাটিতে গা-ঢাকা দেওয়া লোকের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়৷ এই যেমন, ভারত ছেড়ে লন্ডনে পালিয়েছেন শিল্পপতি বিজয় মালিয়া৷ তিনি রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ৷ নিজের সম্পত্তির সঠিক হিসেব দেননি এবং বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন বলে আদালতে অভিযোগ জানিয়েছে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৭টি ব্যাংকের সংগঠন৷ ৯,০০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি মামলায় অভিযুক্ত বিজয় মালিয়া ২০১৬ সালের ২ মার্চ দেশ ছেড়ে পালান৷ অভিযুক্ত কিংফিশার কর্তার নাগাল পেতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলি৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷