1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কালিকা ছাড়া কী করছে দোহার?

১৬ এপ্রিল ২০১৮

কালিকাপ্রসাদ নেই৷ গতবছর ৭মার্চের সফরের পর তাঁর গান গাওয়াও শেষ৷ তবুও বেশ চলছে ‘দোহার’৷ কীভাবে? ডয়চে ভেলের কাছে মুখ খুললেন ‘দোহার’ ব্যান্ডের রাজীব দাস৷

https://p.dw.com/p/2w88x
ছবি: Rajib Das

ডয়চে ভেলে: দুর্ঘটনার রেশ কাটিয়ে উঠলেন কী করে?

রাজীব দাস: দুর্ঘটনার পর সবাই বলছিলেন, কালিকাপ্রসাদের পর দোহারের যাত্রা শেষ৷ এটা আমাদের নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ সবাইকে ডেকে বলেছিলাম, তোমরা কী মনে করছ? কালিকাপ্রসাদের পর দোহারের যাত্রা কি সত্যিই শেষ? প্রশ্নটা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছিল৷ সবার চোখমুখ সেদিন পালটে গিয়েছে৷ তারপর তো চলেছি৷ কেউ আমাদের করুণা করে অনুষ্ঠান দেয়নি৷ স্বমহিমায় আমরা অনুষ্ঠান করে চলেছি তো৷

এবারে কতগুলো অনুষ্ঠান করলেন?

গত এক বছরে ৭০ থেকে ৭৫ টা করেছি,তার কম নয়৷

কালিকাপ্রসাদ ছাড়া স্টেজে উঠতে প্রথমদিন কেমন লেগেছিল?

আমরা বিশ্বাস করি না যে ও আমাদের সঙ্গে নেই৷ আমাদের অনুষ্ঠান যদি দেখেন, তাহলে দেখবেন, স্টেজে একটা ডুবকি রাখা থাকে৷ সবাইকে বলি, আপনারা চোখ বন্ধ করে স্টেজের দিকে তাকান, তাহলে দেখতে পাবেন কালিকাপ্রসাদকে৷ সেইভাবেই ভাবি আমরা৷ কালিকাপ্রসাদ আমাদের সঙ্গেই আছে৷  শেষে দর্শকদের বলি, আপনারা কি দেখতে পেলেন?

রাজীব দাস

স্টেজে কালিকা ছাড়া  দোহারকে দেখে মানুষ কী বলছেন?

৪ বছর বয়স থেকে আমি স্টেজে গান গাই৷ কিন্তু স্টেজে সেভাবে কথা বলা হয়নি৷ প্রয়োজন পড়েনি৷ এখন গানের প্রেক্ষিত বলতে গিয়ে দেখি, অনেকে বলেছেন, কালিকাপ্রসাদ এমন সুন্দর করে বলতেন, আপনারা এটা বলছেন! আমি তাঁদের স্টেজ থেকে নেমে বলি, দেখুন, কারও রিপ্লেসমেন্ট কোনও সময়েই কেউ হয় না৷

কালিকাপ্রসাদ কেন, পাড়ার রিকশাওয়ালারও রিপ্লেসমেন্ট হয় না বলে আমি মনে করি৷ এগুলো গানের প্রেক্ষিত বলা৷ আমাকে কোনওদিনও স্টেজে কথা বলতে হয়নি৷ সেটা কালিকাদা'ই করতেন৷ এখন পরিস্থিতি অনুযায়ী, সেটা করতে হয়৷ 

লোকগান বিকৃত করার রেওয়াজটা এখন চলছে৷ দোহার কী বলে এটা নিয়ে?

প্রত্যেকটা অঞ্চল একেকটা সুরের জন্ম দেয়৷ শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লার ভাটি অঞ্চলের সন্তান আমি৷ আমাদের করিমগঞ্জও সে অর্থে ভাটি অঞ্চল৷ নদীর গতি-প্রকৃতির সুর নিয়ে আমি জন্মেছি৷ মাঝির দাঁড় বাওয়া দেখে বড় হয়েছি৷ আমি অবাধে হাসন রাজা, আবদুল করিমের বা রাধারমণ দত্তের গান উচ্চারণ মেনে গেয়ে দিতে পারব৷ কিন্তু একজন বীরভূমের ছেলে সেটা কী করে পারবেন? তেমনি আমি বীরভূমের ঝুমুর গাইতে পারব না৷ ভাওয়াইয়ার কথা বলি৷ আমাদের দলে অমিত আছে৷ ওর বাবা ভাওয়াইয়া শিল্পী৷ ওর রক্তে ভাওয়াইয়া৷ তাই ভাওয়াইয়া অমিত গায়৷ অমিত গায়, আমরা ওকে কোরাসে সাহায্য করি৷ আমরা মনে করি, যে অঞ্চলের গান, সেটা তেমন করেই গাওয়া উচিত৷ রবীন্দ্রসংগীতের বিশ্বভারতী আছে, তাই লঙ্ঘন করা যায় না৷ লোকায়ত শিল্পীদের ওসব নেই বলে যা ইচ্ছে করা যায়? দোহার সেটা মনে করে না৷ গড়িয়াহাট বালিগঞ্জে বসে আজকাল লোকসংগীত লেখা হয় বটে, কিন্তু সত্যিকারের লোকসংগীত অমনভাবে লেখা যায় না৷ বটবৃক্ষের ছায়া বা মাঝির কষ্ট না বুঝলে লেখা যায় না৷ তাই দোহার লোকসংগীত লেখার চেষ্টা করে না৷ সংগ্রহের চেষ্টা করে৷ এই চেষ্টা এখনও চলছে৷  

সেই সংগ্রহ কীভাবে হচ্ছে এখন? গান নিয়ে গবেষণা করছেন কে?

দেখুন, কালিকাদা আমাদের ফ্রন্টম্যান বা দলনেতা৷ প্রথমদিনে আমাদের, মানে আমার আর কালিকাদার হাত ধরেই দলটা শুরু হয়েছে৷ কালিকাদা চিরকালই ঘরের বাইরেটা দেখতেন৷ দোহারের যখন জন্ম হয়েছে, তখন দোহারের হাতে চার পাঁচ হাজার গান৷ সেটা কালিকাদার জন্যই সম্ভব৷ কালিকাদা'র পরিবারের কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য বা অসমের নৃত্যগুরু মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য এঁদের সংগ্রহে যা গান, সেগুলো সঙ্গে নিয়েই শুরু করেছি পথ চলা৷ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফোক  নিয়ে কালিকাদা ব্যক্তিগতভাবে একটা বড় গবেষণা করেছিলেন....  

সেটা কী?

রাঢ় বঙ্গ অঞ্চলে, মানে টাটা জামশেদপুর রাঁচি শিল্পাঞ্চলে যাঁরা আসছেন, তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের ‘ফোক' নিয়ে আসছেন৷ সেই ফোকটা কীভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, আবার ধরুন, রাঢ়বঙ্গের সাঁওতালিদের বা শ্রমিক শ্রেণির মানুষদের আসামের চা বাগানে নিয়ে যাওয়ার পর, তাঁদের ‘ফোক’ কীভাবে পরিবর্তিত হলো, সেই সুরের জার্নি নিয়ে গবেষণাটা কালিকাদা করছিলেন৷ তাছাড়া বিভিন্ন লোকায়ত শিল্পীর কাছে গিয়ে গান নিয়ে এসে তাকে বিশ্লেষণ করাটাও কালিকাদা'র গবেষণা ছিল৷      

আচ্ছা, এখন কি দোহারের কারো পক্ষে  কালিকাপ্রসাদের মতো গবেষণা করা সম্ভব?

চিরকালই কালিকাদা স্বপ্ন দেখাত, আমরা সবাই সেই স্বপ্ন দেখতাম৷ এই পরিস্থিতির মুখোমুখি কোনওদিন হতে হবে ভাবিনি৷ আজকের পরিস্থিতিতে সেই কাজগুলো আমাদের সামনে থেকে করতে হচ্ছে৷ ফ্রন্টম্যান হিসেবে আমাকে দাঁড়াতে হয়েছে৷ সঙ্গে নিয়ে এসেছি কালিকাদা'র সহধর্মিনী ঋতচেতাকে৷ প্রায় জোর করেই৷ সক্রিয়ভাবে আমাদের সঙ্গে না থাকলেও সবেতে পরোক্ষভাবে জড়িয়েছিলেন তিনি৷ তাই দোহারের সেই সব কাজ করার জন্য আমি আর ঋতচেতা দু'জন মিলে এগোচ্ছি৷ তবে সঙ্গে অন্যান্যরাও আছেন৷ তাই গান সংগ্রহের কাজটা আরও বেশি করে করতে পারব৷ আজকের দিনে সেই কাজ শুরু করেছি৷ এখন আর স্বপ্ন দেখার সময় নেই, বাস্তবায়িত করার সময়৷

কী কাজ চলছে?

এই তো ওয়ার্কশপ চলছে৷ প্রথমবার দোহারের উদ্যোগে ওয়ার্কশপ করলাম তো৷ দারুণ সাড়া পেয়েছি৷

রিয়েলিটি শোয়ের কালিকাপ্রসাদ, নাকি দোহারের কালিকাপ্রসাদ, কে বেশি জনপ্রিয়? 

রিয়েলিটি শোয়ের প্ল্যাটফর্ম একটা বড় ব্যাপার৷ দোহারের কালিকাপ্রসাদ ছিল বলেই আজ রিয়েলিটি শো-তে মানুষ কালিকাপ্রসাদকে দেখতে পেয়েছেন৷ রিয়েলিটি শো-তে যে  কালিকাপ্রসাদ গানের নেপথ্যে কথা বলেছেন, তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা দোহারই তৈরি করেছে৷ আমাদের চর্চা এবং ‘সহজপরব’ নামে যে রুট মিউজিক ফেস্টিভ্যাল হতো ২০১৪ থেকে, এটারও বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে রিয়েলিটি শো-তে৷ কাজেই দোহারের কালিকাপ্রসাদের চর্চা ছিল বলেই সেই কাজটা রিয়েলিটি শো-তে দেখা গিয়েছে৷

বাংলার অন্যান্য ব্যান্ডের থেকে দোহারের নামটাই বেশি শোনা যায় কেন?

দোহারের যখন জন্ম হয়েছিল, তখন আড়াই হাজার ব্যান্ড কলকাতায় ছিল৷ দোহারের ব্যাপারটা অন্যরকম৷ দোহার মানেই ধামসা, মাদল, সারিন্দা, বাঁশি, ঢোল, করতাল, হারমোনিয়াম, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি নয়৷ ১৯৯৯ সালে দোহারের জন্ম৷ তারপর থেকেই লোকসংগীত আজ মেইন স্ট্রিম মিউজিকে এসেছে৷ প্রথমদিন থেকেই আমরা নেহাত গান গাওয়ার জন্য আসিনি৷ লোকসংগীতের ধরনগুলো খুঁজে নিয়ে আসার কাজটাই দোহার করে৷  গানের পাশাপাশি আরও অন্য অনেক কাজ আমাদের করতে হয়৷ বলতে পারেন, এ জন্যই আমাদের নামটা আপনারা শুনতে পান৷

লোকগান নিয়ে দোহারের কর্মশালা

বাংলাদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন?

বাংলাদেশে প্রথমবার গিয়ে বুঝতে পেরেছি, ওখানে কত মানুষ আমাদের ভালোবাসেন৷ ওখানকার বিভিন্ন জেলায় অনুষ্ঠান করেছি৷ আমরা কখনও টুরিস্ট ভিসায় যাই না৷ ওয়ার্ক ভিসায় যাই৷ তাই এখন বাংলাদেশের পলিটিক্যাল অবস্থা অনুকূল না থাকার জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে ডাক পেলেও যেতে পারছি না৷ আমাদের সহজপরবে বাংলাদেশের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন৷

হিসেবদপ্তরের বড় পদের চাকরি ছাড়িয়ে রাজীবকে এই লোকগানের পথে হাঁটিয়েছেন যিনি, তিনি আজ নেই৷ সেই কালিকাপ্রসাদের দেখানো পথ তাই রাজীবসহ দোহারের কাছে বড় পরিষ্কার৷ অনেক কাজ, অনেক প্রকল্প সব নিয়ে হাঁটছেন তাঁরা৷ 

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷