কারাগারে আতঙ্কে আসিফ
২৩ এপ্রিল ২০১৩গত জানুয়ারি মাসে উত্তরায় নিজের কার্যালয়ের সামনে হামলার শিকার হন আসিফ মহিউদ্দীন৷ সেই হামলা ছিল, তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে৷ ইতোমধ্যে একাধিক সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে এই তথ্য৷ আসিফের উপর হামলায় জড়িত সন্দেহে পহেলা এপ্রিল চারজনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ এই গ্রেপ্তারের দু'দিন পরেই অবশ্য আসিফ মহিউদ্দীনকেও আটক করা হয়৷
কারাগারে আসিফ মহিউদ্দীনের বর্তমান অবস্থা জানতে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে৷ নিরাপত্তার খাতিরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আসিফের এক শুভাকাঙ্খী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একই জেলের ভিতরে যেহেতু হামলাকারীরাও আছে তাই আসিফ খুব ভীত৷''
আসিফের সঙ্গে জেল গেটে দেখা করা তাঁর এই শুভাকাঙ্খী বলেন, ‘‘জেলের মধ্যে অন্যান্য আসামীরা ওদের (গ্রেপ্তারকৃত চার ব্লগার) দেখে চিল্লাপাল্লা করছে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে এবং বলছে, ‘আসিফ কোনটা চিনাই দে, হাতের সামনে পাইলে আর টিকতে হবে না' – এসব কথাবার্তা৷''
আসিফের মুক্তি দাবি
এদিকে ঢাকায় সম্প্রতি গ্রেপ্তার চার ব্লগারের মুক্তির দাবিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একাধিক আন্তর্জাতিক সংগঠন৷ নিজেকে ‘নাস্তিক' হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন সহ মশিউর রহমান বিপ্লব, মোহাম্মদ রাসেল পারভেজ ও সুব্রত শুভর মুক্তির দাবিতে সক্রিয় ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিকাল ইউনিয়ন (আইএইচইইউ) এবং এথিস্ট অ্যালায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল (এএআই)৷ এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদেরকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে এএআই৷ পাশাপাশি ‘কাউন্সিল ফর সেক্যুলার হিউম্যানিজম' নামক আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশে আটক ব্লগারদের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে চিঠি পাঠিয়েছে৷ ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ব্লগার অভিজিৎ রায়৷
এছাড়া প্যারিসভিত্তিক রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স আসিফের মুক্তি চেয়ে একাধিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে৷ গত ১২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, ‘‘আটক ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে আটকে রাখা গ্রহণযোগ্য নয়, বিশেষ করে যখন তাঁর পরিবার বলছে যে, সে অসুস্থ৷''
আদালতের নির্দেশনা নিয়ে বিভ্রান্তি
গত জানুয়ারি মাসে দুর্বৃত্তের হামলায় স্পাইনাল কর্ডে আঘাত পান আসিফ মহিউদ্দীন৷ তাঁর ঘাড়েও ব্যথা রয়েছে৷ তিনি এখন ঠিকভাবে হাঁটতে পারছেন না৷ কারাগারের ভেতর তাঁর চলতে হচ্ছে অন্যের সহায়তা নিয়ে৷ ডয়চে ভেলেকে এসব তথ্য জানান আসিফের বোন জুয়েলা জেবুন্নেসা খান৷
কারাগারে দু’বার আসিফকে দেখতে গেছেন জেবুন্নেসা৷ তিনি জানান, আসিফের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় এনে আদালত তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশনা দিয়েছেন৷ গত ১৭ এপ্রিল এই নির্দেশনা দেওয়া হলেও এখনো তা কার্যকর করা হয়নি৷
তবে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেছেন, ‘‘আদালত তাঁর (আসিফ মহিউদ্দীন) প্রয়োজনীয় চিকিত্সার কথা বলেছেন৷ তার যে ধরনের চিকিত্সা প্রয়োজন তা দিতে বলেছেন৷ সুনির্দিষ্টভাবে বাইরের কোনো হাসপাতালে পাঠাতে বলেননি৷’’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ফরমান আলি ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন-উর-রশীদ স্বপনকে জানিয়েছেন, ‘‘তাঁরা আসিফের বাইরে চিকিত্সার কোনো আদেশ পাননি৷ কারাগারের ভিতরে তাঁর যে চিকিত্সা প্রয়োজন তা নিয়ম অনুযায়ী দেয়া হবে৷’’
ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন
প্রসঙ্গত, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে৷ ডয়চে ভেলের ফেসবুক পাতাতেও আসিফের বিষয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে৷ এই ব্লগার মূলত আলোচনায় আসেন ২০১১ সালে৷ সেসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি৷ এই বিষয়ে শাহবাগে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন আসিফ৷ আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের দাবি মানতে বাধ্য হয়৷
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় সেসময় আসিফকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ৷ ১৮ ঘণ্টা পর অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ বাংলাদেশে একটি জনপ্রিয় ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে ডয়চে ভেলের সেরা অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড দ্য বব্স-এর ‘সেরা সামাজিক আন্দোলন' বিভাগে ‘ইউজার প্রাইজ' জয় করেন আসিফ মহিউদ্দীন৷ চলতি বছর আবারও দ্য বব্স অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন কারাবন্দি এই ব্লগার৷
আসিফের আরেক বোন ড. জাহিদা মেহেরুন্নেসা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এখন অনেকে আসিফকে ‘ধর্ম বিরোধী' হিসেবে পরিচিত করতে চাচ্ছে৷ অথচ সে মুক্ত চিন্তার চর্চা করে, ধর্মের বিরোধীতা সে করেনি৷ ব্লগার হিসেবে তার অর্জনগুলোর দিকে কেউ এখন নজর দিচ্ছে না৷ ভাষা আন্দোলনে মমতাজ বেগমের অবদান সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন আসিফ৷ অথচ সবাই এই নারীর অবদান ভুলে গিয়ে৷ আসিফই তাঁকে খুঁজে বের করে এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন মহলের তৎপরতার পর তাঁকে একুশে পদক প্রদান করে সরকার৷''
উল্লেখ্য, আসিফ মহিউদ্দীনকে গ্রেপ্তারের আগেই সামহয়্যার ইন ব্লগে থাকা তাঁর সকল নিবন্ধ মুছে দিয়েছে সরকার৷ বর্তমানে তিনি কারাবন্দি থাকলেও তাঁর ফেসবুক প্রোফাইলে ‘লগ-ইন' করছে কোনো একটি পক্ষ৷ গ্রেপ্তারের পর আসিফকে পাঠানো ফেসবুক বার্তা দেখা হয়েছে বলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিশ্চিত করেছে ফেসবুক৷