1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

কারাগার ঘুরছে দুর্নীতির বৃত্তে

২৯ জানুয়ারি ২০২১

বাংলাদেশের কারাগারের  স্লোগান হলো ‘‘রাখিবো নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’’৷ কিন্তু তা বাস্তবতার সাথে কতটা মেলে? এই কারাগারে জেল হত্যার মতো ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি দুর্নীতি আর অনিয়মের আখড়া হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে৷

https://p.dw.com/p/3oZ1K
কাশিমপুর কারাগার
ছবি: picture-alliance/AP Photo/Yarthur

সম্প্রতি কাশিমপুর কারাগারে আটক হলমার্কের জিএম তুষার আহমেদে এক নারীর সাথে কারাগারের ভিতরেই আলাদা কক্ষে সময় কাটিয়ে কারাগারকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছেন৷ তদন্তে দেখা যাচ্ছে, এটাই প্রথম নয়, কারা কর্মকর্তাদের সহায়তায় এটা কাশিমপুর কারাগারের নিয়মিত ঘটনা৷ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বাইরে না এলে হয়তো এভাবেই চলতো৷

জেল ভিজিটরের কথা

মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান এক সময় জেল ভিজিটর ছিলেন৷ কারা আইনে এই জেল ভিজিটরের বিধান আছে৷ জেল ভিজিটররা মূলত কারাবন্দিদের মানবাধিকারের দিক দেখার সুযোগ পান৷ তারা এর উন্নয়নে নানা সুপারিশ করেন৷ এলিনা খান বলেন, ‘‘আমরা এখন থেকে ১৫-২০ বছর আগে যেমন দেখেছি এখনো তার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে আমাদের কাছে খবর আসে না৷ আমরা অনেক সুপারিশ করেছি৷ তার খুব একটা বাস্তবায়ন কখনোই হয়নি৷’’

তিনি বলেন, জেলখানায় টাকা দিয়ে ভালো থাকা যায়৷ এই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ ওখানে টাকা-পয়সা না দিলে বন্দিরা কোনো সুবিধা পান না৷ আর কারাগারেই মাদকসংক্রান্ত অপরাধসহ নানা অপরাধ হয়৷ রাজশাহীতে একবার এই অনিয়ম নিয়ে কারাগারে অসন্তোষও দেখা দিয়েছিল৷

কারা সংস্কারের সংস্কার প্রয়োজন

১৮৬৪ সালে প্রথম জেলকোড করা হয়৷ এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে কারা সংস্কার কমিশন একবারই হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ৪ নভেম্বর বিচারপতি এফ কে এম এ মুনিমের নেতৃত্বে৷ ওই কমিশন জেলকোড সংশোধনে ১৮০টি সুপারিশ করেছিল৷ তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি৷ ২০১৮ সালে ‘কারাবন্দি সংশোধনমূলক পরিষেবা ও পুনর্বাসন আইন’ নামে একটি নতুন আইন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল৷ তবে তাদের কাজ এখনো শেষ হয়নি৷ কমিটির প্রধান লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক এরই মধ্যে অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে চলে গেছেন৷ বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, তারা কিছু কাজ এগিয়ে রেখে এসেছেন৷ পরবর্তী অগ্রগতি বলতে পারবেন না৷ তবে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান মামুন জানান, কারাগারের উন্নয়নে তারা এখন একটি প্রকল্প বাস্তবান করছেন, যার প্রধান লক্ষ্য কারাবন্দিদের কারাগারের মধ্যেই প্রশিক্ষিত করা এবং তাদের জন্য বিভিন্ন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা৷ তিনি বলেন, তারা কারাগারকে সংশোধন কেন্দ্রে পরিণত করতে চান৷

বাংলাদেশে এখন মোট কারাগার ৬৮টি৷ এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার, বাকিগুলো জেলা কারাগার৷ এসব কারাগারে মোট বন্দি ধারণ ক্ষমতা ৪২ হাজার ৪৫০ জনের, কিন্তু আছে তার প্রায় দ্বিগুণ- ৮২ হাজার ৬৫৪ জন৷ তাদের মধ্যে মধ্যে পুরুষ ৭৯ হাজার ৪৫৪ জন ও নারী ৩ হাজার ২০০ জন৷

দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক জঙ্গি সংখ্যা ছিল তিন হাজার ৯১২ জন৷ এর মধ্যে ১ হাজার ৭৩৩ জনই জামিনে মুক্ত রয়েছেন৷

কারাবন্দিদের চোখে...

কারাগারের বাস্তব চিত্র পাওয়া যায় সেখান থেকে বের হয়ে আসা বন্দিদের কাছ থেকে৷ গত সপ্তাহেই কেরানীগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন রাশেদুল ইসলাম সানি৷ তিনি জানান, ‘‘করোনার সময় দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ থাকলেও ১০-১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে দেখা করার ব্যবস্থা ছিল৷ করোনার কারণে ওই সিন্ডিকেট এখন কারাগার থেকে বাইরে মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য প্রতি তিন মিনিটে ১০০ টাকা নেয়৷’’

তিনি আরো জানান, সিট-বাণিজ্য, জামিন-বাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য ও ক্যান্টিন-বাণিজ্যও চলে কারাগারে৷ একটি সিট পেতে দুই হাজার টাকা দিতে হয় বলে দাবি করেন তিনি৷

ফোনে কথা বলার জন্য সিন্ডিকেট প্রতি তিন মিনিটে ১০০ টাকা নেয়: রাশেদুল ইসলাম সানি

নাজমুল হুদা নামে আরেকজন কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, কারাগারের ভিতরে বিভিন্ন ব্লক অবৈধভাবে লিজ দেয়া হয়৷ আর মাসিক দুই লাখ-আড়াই লাখ টাকার বিনিময়ে এই লিজ নেন কয়েদিদের একটি সিন্ডিকেট৷ যারা কারাগারে যান তারা কোথায় থাকবেন, কতটা ভালো থাকবেন তা নির্ভর করে সিন্ডিকেটের ওপর৷ টাকার বিনিময়ে তারা এই সুবিধা দেন৷ তিনি আরো বলেন, কৌশলে কারাগারে যেমন মাদক ঢোকে আবার কারাগারের ভেতরেই টাকার বিনিময়ে ইয়াবা ও গাঁজাসহ আরো অনেক মাদক পাওয় যায়৷ কারাগারের ভেতরেই একটি সিন্ডিকেট এই মাদক-ব্যবসা পরিচালনা করেন৷

সবার একই কথা

কারাগারের অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এখন দুদকের তদন্ত চলছে৷ আর অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পর্যায়ের দুই শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নাম এসেছে  মন্ত্রণালয়ের তদন্তে৷ ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাসকে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, এক কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে রেলওয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে৷

গত বছরের আগস্টে কাশিমপুর কারাগার থেকে ১২ ফুট উচ্চতার মই বানিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যায় আবুবকর সিদ্দিক নামে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত এক কয়েদি৷ এগুলো কারাগারের দুর্নীতি-অনিয়মের দুটি উদাহরণ মাত্র৷

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি এক বছর আগে কারাগারে অনিয়ম ও দুর্নীতির যেসব খাত খুঁজে পেয়েছে সেগুলো হলো: ক্যান্টিনের অনিয়ম, বন্দি বেচাকেনা, সাক্ষাৎ-বাণিজ্য, সিট-বাণিজ্য, খাবার-বাণিজ্য, চিকিৎসা, পদায়ন, জামিন-বাণিজ্য৷

কারগারে টাকা দিলে শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে যে কেউ অসুস্থ না হয়েও কারা হাসপাতালে আরাম আয়েশে থাকতে পারেন৷ টাকা বেশি হলে বাইরের হাসপাতালেও থাকার সুযোগ আছে৷ আর জামিনের আদেশ কারাগারে যাওয়ার পর টাকা না দিলে বন্দিরা ছাড়া পান না৷ সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী কারা ক্যান্টিনের দুর্নীতির উদাহারণ দিয়ে বলেন, ‘‘ক্যান্টিনে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ১৮শ' টাকা৷ আর যেখানে  কারাগার বড়, সেখানেই পোস্টিং চায় অনেকে ৷ কারণ, সেখানে লাভ বেশি৷’’

এলিনা খান বলেন, কারাগারে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি বন্দি থাকায় দুর্নীতির সুযোগ বেড়ে যায়৷

যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে

কারাগারকে সংশোধনমূলক কেন্দ্রে পরিণত করার জন্য কয়েকটি প্রকল্পের কাজ এখন চলছে৷

দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে: আইজি প্রিজন

কারাগারে এখন উৎপাদন শাখা নামে আলাদা একটি শাখা করা হয়েছে৷ দেশের ২৮ টি কারাগারে এখন কারাবন্দিরা ৩৮টি ট্রেডে বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ পাচ্ছেন৷ তারা উৎপাদনে সম্পৃক্ত হচ্ছেন৷ ২০১৪ সাল থেকে ২৪ হাজার বন্দিকে তাদের কাজের লভ্যাংশ থেকে ৭০ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে বলে জানান আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মোমিনুর রহমান মামুন৷

তিনি বলেন, খাবার উন্নত করা হয়েছে সব কারাগারে ৷ ২০০ বছর ধরে চলে আসা নাস্তায় রুটি গুড় এখন আর দেয়া হয় না৷ এখন খিচুড়ি, সবজি, রুটি, হালুয়া দেয়া হয়৷ বিশেষ দিনে উন্নত খাবার দেয়া হয়৷ আদালতে হাজিরা দিতে যাওয়া বন্দিদের আগে খাবারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, এখন তার ব্যবস্থা হয়েছে৷ কাশিমপুর এবং কেরানীগঞ্জ কারাগারে লাইব্রেরি, জিমনেশিয়াম করা হয়েছে৷ খেলাধুলার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ বন্দিদের জন্য পরিবারের সাথে টেলিফোনে কথা বলার ব্যবস্থা করা হয়েছে৷

আরো আটটি কারাগারে এই সংস্কারের কাজ চলছে৷ সেখানে ধারণক্ষমতাও বাড়ানো হচ্ছে৷ কিন্তু সব কারাগারে এই উন্নয়ন একসঙ্গে সম্ভব নয় বলে তিনি জানান৷ এটা সরকারের বরাদ্দের ওপর নির্ভর করছে৷ তবে তার মতে, সরকার আন্তরিক৷

তিনি কারাগারে দুর্নীতি-অনিয়মের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘‘আমি যোগ দেয়ার পর থেকে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে৷ ক্যান্টিনসহ যেখানে দুর্নীতির সুযোগ আছে, সেখানে আমরা অডিটসহ নানা মনিটরিং সিস্টেম চালু করছি৷ আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, কারুর দুর্নীতি ধরা পড়লে তিনি রেহাই পাবেন না৷’’

কারাগারের নিরাপত্তায় প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে সব কারাগারকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে৷ আরো কিছু আধুনিক নিরাপত্তা ডিভাইস বসানোর উদ্যোগের কথাও জানান তিনি৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য