কাবুলে নিরাপত্তার গ্যারান্টি নেই
২২ মে ২০১৭আমরা কাজে ডুবে রয়েছি৷ শরণার্থীদের দেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ পড়ছি, শুনছি৷ আমির, নুরি, মুজতবা ও ইসা আমাদের কাবুলে বসবাসের আতঙ্কের কথা শোনাচ্ছে৷ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নাকচ হবার পর জার্মানি থেকে তাদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠানো হয়েছে৷ তাদের কথা শুনতে শুনতেই সুইডেনের সাহায্যকারী সংগঠন ‘অপারেশন মার্সি'র উপর হামলার ভয়ংকর খবর কানে এলো৷ শুনে বিহ্বল হয়ে পড়লাম৷ সব হামলাই ভয়ংকর – তা সে কাবুল, প্যারিস, ব্রাসেলস, নিস, বার্লিন – যেখানেই হোক না কেন৷
এখনো এই হামলা সম্পর্কে সব তথ্য জানা যায়নি৷ কাবুলে পরিচিতদের ফোন করে আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আফগান সহকর্মীদের রিপোর্ট পর্যবেক্ষণ করছি৷
নিজেদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে কুশল সংবাদ জানালাম৷ আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবরা টেলিফোন, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করছে৷ জার্মানি থেকে বিতাড়িত তরুণরা জার্মান ভাষা যথেষ্ট জানেন, তাঁরা আমাদের টেলিফোন সংলাপ শুনে বুঝতে পারছেন৷ মুজতবা ও ইসা আমাদের কাছে শোক প্রকাশ করলেন৷ আমরা প্রধান সম্পাদক ও নিরাপত্তা সমন্বয়কের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বিচার করতে লাগলাম৷
হামলার লক্ষ্য ছিল বিদেশিরা
গোটা চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে৷ বিদেশিরাই শনিবারের রাতের হামলার লক্ষ্য ছিল৷ সাহায্যকারী সংগঠনের বসতবাড়িকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল৷ এক আফগান প্রহরী ও এক জার্মান সাহায্যকারী নারী নিহত হয়েছেন৷ ফিনল্যান্ডের এক সাহায্যকারী নারীকে অপহরণ করা হয়েছে৷ কাবুল শহরে বিদেশিদের উপর এটাই প্রথম সুপরিকল্পিত হামলা নয়৷ তবে আফগানিস্তানের নিরীহ মানুষরাই বেশিরভাগ হামলার লক্ষ্য হন৷ চলতি বছরের শুরু থেকে কাবুলে কমপক্ষে ৭টি বড় হামলা ঘটেছে, যার ফলে কয়েকশ' মানুষ হতাহত হয়েছে৷ হয় তালিবান, কিংবা স্বঘোষিত ‘ইসলামিক স্টেট' এই সব হামলার দায় স্বীকার করেছে৷
গত কয়েক দিনে আমরা আফগানিস্তানের রাজধানীতে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি দেখেছি৷ বিস্ফোরণ-প্রতিরোধক প্রাচীর ও কাঁটাতারের বেড়ার মাধ্যমে শহরটিকে প্রায় দুর্গ করে তোলা হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও কয়েক দিন আগে বিমান অবতরণের সময় সবকিছু বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল৷ গাঢ় নীল আকাশে সূর্যের আলো দেখা যাচ্ছে৷ যেসব মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তাদের বেশ খোলামেলা ও বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে৷ তবে সেই শান্তি যে কতটা ভুয়া, তা শুধু এই একটি হামলাই দেখিয়ে দিচ্ছে না৷
কাবুল শহরে নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি নেই৷ আজ যে এলাকা শান্তিপূর্ণ মনে হচ্ছে, আগামীকাল তা হামলার লক্ষ্য হতে পারে৷ যাত্রার আগে আমরা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভেবে রেখেছি৷ সংকটপূর্ণ এলাকায় কাজের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিষ্ঠানের স্পষ্ট বিধিনিয়ম রয়েছে৷ আমরা সেই নির্দেশ মেনে চলছি এবং নিজেদের বোধশক্তি অনুযায়ী চলছি৷ এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়৷
সন্ত্রাস ও হিংসা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো সহযোগীরা আফগানিস্তানে আবার আরও সৈন্য পাঠানোর যে ইচ্ছা প্রকাশ করছে, যার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সে বিষয়ে তাদের মতামত জানতে চাইছি৷ অনেকে বলছেন, বাকি কোনো পরিবর্তন ছাড়া শুধু সৈন্য পাঠিয়ে কী হবে? কেউ বলছেন, ‘‘আফগানিস্তানের মানুষ হিসেবে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি৷ তাছাড়া অন্তর্কলহ ভুলে আমাদের সরকারের দেশ শাসন করা উচিত৷'' কারো মতে, আরও বিদেশি সৈন্য এনে কী হবে, যদি তাদের লড়াই করার অনুমতি না থাকে! কেউ বলছেন, অসংখ্য মিলিশিয়া বাহিনীকে নিরস্ত্র করে শুধু সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করা উচিত৷ ন্যাটো বিফল হয়েছে বলেও কেউ কেউ মনে করে৷ তারা জাতিসংঘের শান্তি বাহিনী দেখতে চাইছে৷ আন্তর্জাতিক সমাজের কাছে তারা শিক্ষার বদলে সবার আগে নিরাপত্তা চাইছে৷
এত রকমের উত্তর সত্ত্বেও যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তা হলো, কাবুল শহরে কেউ নিরাপদ বোধ করছে না৷ তবে সবাই সেই ঝুঁকি সত্ত্বেও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা চালিয়ে যাচ্ছে৷ একটি বাক্য প্রায়ই আমরা শুনতে পাই – ‘‘সকালে বাড়ি থেকে বেরোলে সন্ধ্যায় জীবন্ত অবস্থায় ফিরতে পারবো কিনা, তা জানি না৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও বাঁচতে তো হবেই৷''
আমরা আজ এই শহরে বিদেশি অতিথি হিসেবে এই মারাত্মক হামলা সত্ত্বেও গতকালের তুলনায় বাড়তি বিপদের মধ্যে নেই৷ আফগানিস্তানের রাজধানীতে সন্ত্রাস ও হিংসা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ৷ সেইসঙ্গে রয়েছে অপরাধচক্রগুলির রমরমা৷ অপহরণ ব্যবসার আকার নিয়েছে৷
কাবুলের দৈনন্দিন জীবন তুলে ধরতে আমরা সাংবাদিক হিসেবে এখানে রয়েছি৷ এর আগেও কয়েকবার এখানে এসে কাবুল, তথা আফগানিস্তানের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে৷ আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলছে৷ প্রায় ১৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিক সেনা অভিযানের ফলে দেশের অগ্রগতি হয়েছে, দেশ আরও উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে বটে, কিন্তু শান্তি ও নিরাপত্তা আসেনি৷
পেটার্সমান/শ্যুলকে-গিল/এসবি