'কাকু'র স্বরেই কি নিয়োগ দুর্নীতির চাবিকাঠি?
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইডির হাতে গত মে মাসে গ্রেপ্তার হন সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে 'কালীঘাটের কাকু'। আদালতের নির্দেশের পর পাঁচ মাস কেটে গেলেও তার কণ্ঠস্বরের নমুনা হাতে আসেনি তদন্তকারী সংস্থার।
নিয়োগ দুর্নীতিতে 'কাকু'
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী থেকে কয়েকজন কর্তা দীর্ঘদিন জেলবন্দি। এই মামলায় গত মার্চ মাসে গ্রেপ্তার করা হয় সুজয়কৃষ্ণকে। তার বাড়ি, অফিস-সহ একাধিক জায়গায় তল্লাশি চালায় এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট।
গ্রেপ্তারের পর থেকেই সুজয়কৃষ্ণ নানা শারীরিক অসুস্থতার কথা বলেছেন। স্ত্রী বিয়োগের পর জেল থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন প্যারোলে। তারপর থেকে তিনি চিকিৎসাধীন এসএসকেএম হাসপাতালে। বুকে ব্যথার সমস্যা, অস্ত্রোপচার ইত্যাদিতে অনেকটা সময় গড়িয়ে গিয়েছে।
নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে ভদ্রের নামে চার্জশিট পেশ করেছে ইডি। সূত্রের খবর, তার বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগ তোলা হয়েছে। এই অভিযোগ প্রমাণের জন্য তদন্তকারীদের অন্যতম হাতিয়ার সুজয়কৃষ্ণের ফোন রেকর্ড। এজন্যই দরকার তার কণ্ঠস্বরের নমুনা।
গত জুলাই মাসে হাইকোর্ট বলে দেয়, তদন্তকারী সংস্থা অভিযুক্তের কণ্ঠস্বরের নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে। তবে শর্ত ছিল, চিকিৎসকদের অনুমতি সাপেক্ষে নমুনা নিতে হবে। এখানেই আটকে যাচ্ছে ইডি। বারবার চেষ্টার পরও তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কাকুর নমুনা সংগ্রহ করতে পারছে না।
নমুনা কেন অধরা
সুজয়কৃষ্ণকে জেরা করে কয়েকজনের নাম উঠে আসে বলে দাবি তদন্তকারীদের। সূত্রের খবর, বিষ্ণুপুর থানার এক সিভিক ভলান্টিয়ার রাহুল বেরার সঙ্গে সুজয়কৃষ্ণের যোগ রয়েছে। তল্লাশি চালিয়ে রাহুলের ফোন বাজেয়াপ্ত করে ইডি। সেই ফোনের একটি কল রেকর্ডিং ইডির হাতে আসে।
কেন্দ্রীয় সংস্থার দাবি, এই সুজয়কৃষ্ণই রাহুলকে ফোনে থাকা কিছু তথ্য মুছে ফেলার নির্দেশ দেন। সেই কল রেকর্ডিংয়ের একটি কন্ঠস্বর সত্যিই ভদ্রের কি না, তা জানতেই ফরেনসিক পরীক্ষা দরকার। হাসপাতালের কাছে এই উদ্দেশ্যে বারবার আবেদন জানিয়েছে ইডি। কিন্তু চিকিৎসকদের অনুমতি মেলেনি।
গত শুক্রবার স্বরের নমুনা মিলবে, এমন সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেদিনই তাকে এসএসকেএম থেকে জোকা ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে ফেলেছিল ইডি। তৈরি ছিল মেডিক্যাল বোর্ড।
কিন্তু হাসপাতাল থেকে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, শারীরিক পরিস্থিতির ‘অবনতি' হওয়ায় সুজয়কৃষ্ণকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়েছে। ফলে তাকে ইএসআই নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। চলতি সপ্তাহে আইসিইউ থেকে কেবিনে ফেরানো হয়েছে তাকে। এবার তার কণ্ঠের নমুনা সংগ্রহের জন্য ফের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইডি।
কন্ঠ কেন গুরুত্বপূর্ণ
ভারতে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে ইতিমধ্যেই সাবেক মন্ত্রী-সহ অনেক প্রভাবশালীর যোগ উঠে এসেছে। এই তালিকা আরও দীর্ঘ হতে পারে বলে অনুমান তদন্তকারীদের। ইডির দাবি, একাধিক সংস্থার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করানোর নেপথ্যে ছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। এর মধ্যে অন্যতম লিপস এন্ড বাউন্ডস সংস্থা।
প্রেস বিবৃতিতে তদন্তকারীরা বলেন, এই সংস্থার সিইও পদে ছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এখানে চিফ অপারেটিং অফিসার হিসেবে কাজ করেছেন ভদ্র। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি তৃণমূলের শীর্ষনেতাকে 'সাহেব' বলেও সম্বোধন করেন।
নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ইতিমধ্যে অভিষেককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, এই দুর্নীতির সঙ্গে তার এক টাকা যোগের প্রমাণ দেখাতে পারলে তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবেন।
স্বর বদলের অভিযোগ
বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনামাফিক ভদ্রের স্বরের নমুনা সংগ্রহে বাধা দিচ্ছে। প্রভাবশালীদের আড়াল করতেই এ কাজ করছে রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এসএসকেএম হাসপাতাল।
এমনকি কণ্ঠস্বর বদলে অস্ত্রোপচার করা হবে, এমন অভিযোগও তুলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার ও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকী 'কাকু'র প্রাণনাশের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।
তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধীদের যাবতীয় দাবি খারিজ করে দিয়েছে। দলের মুখপাত্র শান্তনু সেনের বক্তব্য, ''বিরোধীদের এখন ভরসা কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাই তারা ভিত্তিহীন দাবি করছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, চিকিৎসকের অনুমতি পেলেই ইডি নমুনা সংগ্রহ করতে পারবে।''
রাজ্যের সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''অপরাধবিজ্ঞান অনুযায়ী ফিঙ্গারপ্রিন্ট বদলের চেষ্টা হয়েছে। সেটা কিন্তু সবসময় ব্যর্থ হয়নি। তাই স্বরের ক্ষেত্রে কী হবে, সেটা চিকিৎসকরা ভালো বলতে পারবেন। তবে রাজ্য ও কেন্দ্রের সমঝোতাতেই ইডি নমুনা সংগ্রহ করতে পারেনি। আর রাজ্য সরকার চায় না, তার দলের নেতারা বিপাকে পড়ুক।''
সত্যিই কি কণ্ঠস্বর বদল করা সম্ভব? কলকাতার শীর্ষস্থানীয় নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত বলেন, ''অপারেশন করে কণ্ঠস্বর বদলে দেওয়া সম্ভব। ভালো কণ্ঠস্বর খারাপ করা যায়, খারাপ কন্ঠ ভালো করা যায়। প্লাস্টিক সার্জারিতে কারো মুখ পাল্টে দিলেও আসল মুখ কী ছিল জানা যায়। ঠিক সেভাবেই কন্ঠ বদলের পরও ফরেন্সিকে সঠিক স্বর চেনা যায় কি না, সেটা দেখতে হবে।''