কল্পিত ইসলামিক জনগোষ্ঠী বা মুসলিম উম্মার ধারণা বদলে দিল অনেক কিছু
১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯সীমানাহীন একটি কল্পিত ইসলামিক জনগোষ্ঠী বা মুসলিম উম্মার ধারণা বদলে দিয়েছে অনেক কিছু৷ রাজনৈতিক ফায়দা লাভের আশায় উম্মার ধারণাকে জঙ্গিবাদের অপর এক নাম হিসেবে দেখতে শুরু করেছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অনেকেই৷ আর সেখানেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে সেতুবন্ধের৷
ইসলাম নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠানে মুসলিম উম্মা নামের একটি শব্দ হামেশাই শুনতে পাওয়া যায়৷ যার আক্ষরিক অর্থ - ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ গোটা মুসলমান সমাজ৷ এমনকি সম্প্রতি, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজিউল হাসান খান তাঁর এক বক্তৃতায় দাবি করেন, আমরা বাঙালি জাতি নই, আমরা ইসলামি উম্মা৷
কি এই ইসলামি বা মুসলিম উম্মা ?
সুদূর নরওয়েতে সাম্প্রতিক একটি সম্মেলনে ঠিক এ বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিশেষজ্ঞ, ঐতিহাসিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সাংবাদিকরা৷ বিশ্বায়নের যুগে ইসলামি পুনর্জাগরণ : মিথ, স্মৃতি এবং অনুভূতি - এই নামের আড়ালে আয়োজিত সম্মেলনের সংগঠক ইটসচাক ভাইসমান জানান : কল্পনা হিসেবে এর অস্তিত্ব আছে, বাস্তবে হয়তো নয়৷ সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে এবং বিশ্বব্যাপী এই সম্পর্ক আজ গড়ে উঠছে - কখনো ইন্টারনেটের মাধ্যমে অথবা কখনো কেবেল টিভির মাধ্যমে৷ এবং এই সূত্রে বলা যেতে পারে, উম্মার একটি সংহত ধারণা তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু, উম্মার মাঝে মতপার্থক্যও রয়েছে৷ কারণ, মুসলমানদের মধ্যে মতাদর্শগত পার্থক্যও রয়েছে৷ তাদের মধ্যে জেহাদি রয়েছে, মধ্যপন্থী রয়েছে, এমনকি সুফিরা রয়েছে৷ ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান ভিন্ন৷ যেমন মিশরের মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নাইজিরিয়া বা ভারতীয় মুসলমানদের থেকে আলাদা৷ আবার একই দেশে বসবাসকারী মুসলমানদের মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে - পার্থক্য রয়েছে নারী-পুরুষে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে৷ সুতরাং, উম্মা কল্পিত এক জনগোষ্ঠী ছাড়া আর কিছু নয়৷
প্রশ্ন হল - আত্মপরিচয় ধর্মীয় সচেতনতা একই ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে কতটুকু যোগসূত্র সৃষ্টি করতে সক্ষম ? জাপানে বসবাসকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্যালি অগাস্টাইন বললেন : ধর্ম হিসেবে, সম্প্রদায় হিসেবে আত্মপরিচয় নিয়ে সচেতনতার একটা ব্যাপার গড়ে উঠতে দেখছি আমরা৷ আমার মতে, একই ধর্মের মানুষরা নিজেদের মধ্যে একটা ঐক্যসূত্র খুঁজতে চেষ্টা করে সবসময়েই৷ এ ঘটনা আঞ্চলিক স্তরে চোখে পড়ে৷ আর বর্তমানে মিডিয়ার বিস্তারের কারণে আন্তর্জাতিক স্তরেও এ ধরণের একটা সচেতনতা প্রত্যক্ষ করা যায়৷
খুব স্বাভাবিকভাবেই, আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি-কে কিছু মানুষ তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে৷ আবার একই সময়, পরিচয়ই মানুষকে একটি বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করে৷ এবং সেই সঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে ভিন্ন বলে চিহ্নিত করে৷ ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই প্রকাশ পায় কোন ব্যক্তির ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচিতি৷ তার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় ব্যক্তিগত বিশ্বাস, স্মৃতি অথবা অনুভূতির প্রকাশ৷ আর ধর্মের কথা বললেই চলে আসে ধর্ম প্রচারকদের কথা৷ মুক্ত অর্থনীতির এ যুগেও তাদের দেখা যায়৷ জানালেন ইসরায়েল থেকে আসা শশ বেন-অরি৷ তাঁর কথায় : মসজিদ অথবা শুক্রবারের নামাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাঝে আমরা তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করি৷ অবশ্য ব্যক্তি বিশেষের ওপর একজন ধর্ম প্রচারকের জনপ্রিয়তা নির্ভর করে৷ অর্থাৎ, ক্যারিসমার তারতম্যে তিনি কম বা বেশি জনপ্রিয় হতে পারেন৷ তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পেতে পারে৷ কোন একটা সময় তিনি হয়ত নিজের একটা ওয়েবসাইটও খুলে বসেন৷ চলে ইমেল মারফত কথোপকথন৷ এহেন কোন কোন ধর্ম প্রচারকদের আবার বিশাল সংখ্যক ফ্যানও থাকে৷ বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের জনপ্রিয়তা হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের থেকে কম নয়৷
জনপ্রিয় ঐতিহাসিক বিশ্বাস
কিন্তু, এর থেকেও বড় সমস্যা থেকে যায় মানুষের মননে৷ যাকে ঐতিহাসিক মার্ক সেডগভিক চিহ্নিত করেছেন জনপ্রিয় ঐতিহাসিক বিশ্বাস হিসেবে৷ তাঁর মতে, কোন বিশেষ সময়ের ইতিহাস লিখতে হলে সে সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা ছাড়াও মানুষের স্মৃতি এবং বিশ্বাসের গুরুত্ব অপরিসীম৷ তাঁর কথায় : পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই উম্মার ধারণা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত৷ তারা চিন্তিত জিহাদিদের তত্ত্ব নিয়ে, তাদের দর্শন নিয়ে৷ আর সেটা হওয়াই যে স্বাভাবিক৷ যেমন আরব বিশ্বের অনেকের ঐতিহাসিক বিশ্বাস কিন্তু জিহাদি দর্শনের বেশ কাছাকাছি৷ আর সে জন্য উম্মার ধারণাটিও বহু ক্ষেত্রে কাজ করে থাকে৷ সেই বিশ্বাস থেকেই জিহাদিরা শক্তি সঞ্চার করে৷ কিন্তু সমস্যাটা হলো এর বিপরিতমুখী একটি ইতিহাস তৈরি করা৷ কারণ, মানব মনে জনপ্রিয় ঐতিহাসিক বিশ্বাস সত্যিই অত্যন্ত গভীর হয়৷ একে প্রতিরোধ করার একমাত্র পথ - কর্ম নয়, কর্মপদ্ধতি পরিবর্তন করা৷ আর তাহলেই প্লেন দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা বা জঙ্গিবাদ তার সমর্থন হারাতে পারে৷
সত্যি, নাইন-ইলেভেনের ঘটনাকে কার না মনে আছে ! তাহলে কি এহেন একটা ধারণাকে কেন্দ্র করেই কী মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ইসলামি জঙ্গিবাদ ? নরওয়ের সম্মেলন সংগঠক ইটসচাক ভাইসমান কিন্তু জানালেন অন্য তথ্য৷ তিনি বলেন : ১৯৬০ থেকে, বিশেষ করে ১৯৭০ সাল থেকে ইসলামি পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করছি আমরা৷ এদের মধ্যে বেশিরভাগের ভিত্তিই মৌলবাদ বা জঙ্গিবাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে৷ আশ্চর্যের বিষয়, এটা এমন একটা সময় ঘটতে শুরু করে, যখন বিশ্বায়ন শুরু হয়েছে সবে৷ সে সময় এক নিমেষেই পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয় চলে আসে৷ নতুন নতুন মিডিয়া, প্রচার মাধ্যম চলে আসে বাজারে৷ সেই সূত্র ধরে অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়৷ ইসলাম আরো গুরুত্ব পেতে থাকে৷
ইসলামের পুনরুত্থান বা পুনর্জাগরণ তো আর জঙ্গিবাদ নয়
ভারতের জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জার্মান বংশোদ্ভূত মিশায়েল ডুশের মতে, ইসলামের সঙ্গে জঙ্গিবাদকে এক সঙ্গে দেখলে চলবে না৷ কারণ, যে কোন ধর্মের মানুষই জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে৷ আর ইউরোপেও তার ব্যতিক্রম দেখা যায় না৷ বর্তমানে জার্মানিতে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়ছে৷ কিন্তু, এটা কোন ধরণের ভয়ের কারণ নয়৷ সেখানকার অমুসলমানরা বা অমুসলমান তরুণ সম্প্রদায় মুসলমানদের তুলনায় কোন অংশে কম বা বেশি শঙ্কার কারণ কখনোই নয়৷ বরং সমাজে সব ধর্মের সহাবস্থান এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি-নির্ধারণ করাটাই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা উচিৎ৷ জানান মিশায়েল ডুশে৷
তাহলে ? আদতে উম্মার পিছনে কি ধরণের উদ্দেশ্য কাজ করে থাকে ? নিজেকে হিজাবের আড়ালে লুকিয়ে রাখা তুর্কী বংশোদ্ভূত মোনা হাসান জানান : ইসলামি পুনর্জাগরণ আন্দোলনের অনেকটাই মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি গড়ে তুলতে বিশেষভাবে আগ্রহী৷ এ যেন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক - সব ক্ষেত্রে এক ধরণের কল্যাণমুখী চেতনা তৈরি করা৷ তবে বর্তমান সময়ে, ইসলামি উম্মার অস্তিত্বের কথা ভাবতে গেলে, রাজনৈতিক দিকটাকেই প্রাধান্য দিতে হবে৷ ব্যাপারটা দেখতে হবে মুসলমানদের আবেগ অনুভূতি, চিন্তাভাবনা, আশা, আকাঙ্ক্ষা - তাদের পরস্পর সম্পর্কে আগ্রহের প্রেক্ষাপটেই৷ তারপর অবশ্য সেটাকে অন্য এক পর্যায়ে টেনে নেওয়া যেতে পারে৷ মানবজাতির বাকি অংশের ব্যাপারে তাদের আগ্রহের প্রেক্ষাপটে দেখা যেতে পারে উম্মাকে৷
তাছাড়া, এক দেশের মানুষ আবেগের সঙ্গে উম্মা ব্যাপারটি যেভাবে অনুধাবন করেন, অন্য দেশের মুসলমানরা হয়ত সেভাবে দেখে না৷ ইসলামে ছোট জাতের মুসলমান বা দ্ররিদ্রদের উপহাস অথবা অবজ্ঞা করার কোন বিধান নেই৷ অথচ মধ্যপ্রাচ্যে নাকি বাংলাদেশিদের মিসকিন বলে অবজ্ঞা করা হয়৷ ন্যায্য মজুরি থেকে তাদের অনেককে বঞ্চিত করার অভিযোগ আছে৷ এবং প্রতিবাদ করলে, নির্দয় প্রহারে জোর করে দেশে ফেরৎ পাঠানোর ঘটনাও বিরল নয়৷ সেক্ষেত্রে, কল্পিত জনগোষ্ঠী হিসেবে উম্মার ধারণা কি আদৌ কার্যকর হওয়া সম্ভব ?
প্রতিবেদক: দেবারতি গুহ
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক