কলকাতায় গোয়েটে ইন্সটিটিউটের ঠিকানা বদল
২৪ এপ্রিল ২০১৭কলকাতায় জার্মান ভাষাচর্চা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গোয়েটে ইন্সটিটিউট বলতেই বোঝাতো ৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ঠিকানায়, চমৎকার এক টুকরো উঠোন আর বাগানে ঘেরা তিনতলা বাড়িটি৷ মাক্সমুয়েলার ভবন৷ নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে পাঠকের সাক্ষাৎ, বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী-কোরিওগ্রাফার পিনা বাউশের অনুষ্ঠান, বের্টোল্ট ব্রেশটের বহু নাটকের বাংলা মঞ্চায়ন, এছাড়াও বছরভর নানা ধরনের অনুষ্ঠান, প্রদর্শনীর সুবাদে কলকাতার সাংস্কৃতিক মহলে বিশেষ কদর ছিল এই বাড়ির৷
মাক্সমুয়েলার ভবনের প্রাঙ্গনে ওপেন এয়ার ক্যাফেটিও খুব জনপ্রিয় ছিল শহরের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে৷ শুধু আড্ডার জায়গা হিসেবে নয়, নিয়মিত সংযোগ রাখা, মত বিনিময়, বিতর্কের জন্যেও তাঁরা বেছে নিতেন এই ক্যাফেকে৷ এছাড়া জার্মান ভাষা শিখতে আসা ছেলে-মেয়েদের দিনভর আনাগোনা তো ছিলই৷
অবশ্য এখনই সবকিছু ‘ছিল' বলে অতীতে ঠেলে দেওয়ার কারণ নেই৷ আরও সপ্তাহ দুয়েক সময় আছে৷ কিন্তু তার পরেই ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে ৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড৷ ৭ মে গোয়েটে ইন্সটিটিউট তার ঠিকানা বদলে চলে যাবে মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট আর মির্জা গালিব স্ট্রিটের সংযোগস্থলে, কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ইমারত ‘পার্ক ম্যানসন'-এর একটি তলায়৷ অবস্থানগত দিক দিয়ে অনেক ভালো জায়গায় তো বটেই, পরিসরেও এখনকার থেকে অনেক বড় আয়তনের হবে কলকাতার সেই নতুন গোয়েটে ইন্সটিটিউট৷
কলকাতার গোয়েটে ইন্সটিউট ভারতের প্রথম জার্মান ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র, যার পত্তন হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, ভারতের স্বাধীনতার ১০ বছর পরে৷ আজ থেকে ৬০ বছর আগে৷ প্রথমে কলকাতার ডালহৌসি, অধুনা বি-বা-দী বাগ এলাকার একটি বাড়িতে, সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে দক্ষিণ কলকাতার ম্যান্ডেভিল গার্ডেন্স এলাকার একটি বাংলো বাড়িতে এবং ১৯৬৮ সালে এই বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ঠিকানায়৷ পরের প্রায় ৫০ বছর ধরে এই বাড়িই ছিল জার্মান ভাষাশিক্ষা, জার্মান ফিল্ম, থিয়েটার, সেমিনার, কনসার্টসহ অজস্র অনুষ্ঠান, প্রদর্শনীর প্রাণকেন্দ্র৷
গোয়েটে ইন্সটিটিউট কলকাতার বর্তমান ডিরেক্টর ফ্রিজো মেকার সেই দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ধারাকেই মনে করলেন এই পুরনো বাড়িকে বিদায় জানানোর সময়৷ বললেন, গুন্টার গ্রাস বা পিনা বাউশের মতো বিখ্যাত নামের পাশাপাশি অসংখ্য সাধারণ সংস্কৃতিমোদী মানুষজন মাক্সমুয়েলার ভবনকে সজীব রেখেছেন৷ অজস্র আগ্রহোদ্দীপক আলোচনা, বিভিন্ন বিষয়ের কর্মশালা, কনসার্ট, প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র উৎসব হয়েছে এখানে৷ অনুষ্ঠান ছোট হোক বা বড়, একই আবেগ নিয়ে তার উদ্যোগ, আয়োজন হয়েছে৷ নতুন ঠিকানাতে গিয়েও একইরকম থাকবে কলকাতার গোয়েটে ইন্সটিটিউট৷ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ধারার, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের মেলামেশা আর মত বিনিময়ের জায়গা হয়ে থাকবে এই কেন্দ্র৷
তবে কলকাতার যাঁরা দীর্ঘদিন মাক্সমুয়েলার ভবনের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সবারই মন খারাপ এই ঠিকানা বদলে৷ যেমন সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত৷ ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের প্রাক্তন কর্মী শুভরঞ্জন মনে করেন, এটা খুব ভুল একটা সিদ্ধান্ত৷ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ওই বাড়ি কলকাতার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে এক আইকনিক ল্যান্ডমার্ক৷ নতুন বাড়ি সেই স্বাতন্ত্র রক্ষা করতে পারবে কি না, সে নিয়ে শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত রীতিমতো সন্দিহান৷
দীর্ঘ সময় এই বাড়িতে জার্মান ভাষা শিখিয়েছেন সুনন্দা বসু৷ তিনিও দুঃখিত, কারণ, জীবনের বহু আনন্দময় অভিজ্ঞতার সাক্ষী ওই বাড়ি৷ তিনি অবশ্য মনে করছেন, নিশ্চয়ই কোনও উপায় ছিল না, তাই ঠিকানা বদল করতে হচ্ছে৷ তবে নতুন বাড়ি নিয়ে তাঁর গলাতেও সংশয়ের সুর৷ বিশেষ করে আক্ষেপ এখনকার মাক্সমুয়েলার ভবনের চমৎকার প্রেক্ষাগৃহটি নিয়ে৷