বদলে যাচ্ছে কলকাতা বইমেলা?
৩১ জানুয়ারি ২০১৭২০১৭ সালের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার এবার একটা পরিকাঠামোগত অসুবিধা হয়েছে শুরুতেই৷ ইএম বাইপাসের ধারে যে মিলনমেলা প্রাঙ্গনে বইমেলা বসে, সেখানে তিন দিন আগেই শেষ হয়েছিল রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ‘ডেস্টিনেশন বেঙ্গল' শীর্ষক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলন৷ তার জন্য মেলার মাঠে অতিরিক্ত একাধিক অতিকায় অস্থায়ী ‘হ্যাঙ্গার' তৈরি হয়েছিল, যেগুলো দু'দিনের মধ্যে খুলে ফেলে মিলনমেলাকে তার ফাঁকা জায়গা ফিরিয়ে দেওয়া কার্যত সম্ভব ছিল না৷ ফলে রাজ্য সরকার এবং বইমেলার উদ্যোক্তা পশ্চিমবঙ্গ পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বইমেলায় যেসব ছোট স্টল হয়, সেগুলোকে ঐ হ্যাঙ্গারের মধ্যে জায়গা দেওয়া হবে৷ ফলে এবার শুরু থেকেই একটা বদ্ধ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বইমেলায়, যার সঙ্গে কেউই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না৷
এরকমই একটা হ্যাঙ্গারের মধ্যে দেখা হলো পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ প্রকাশনা সংস্থা দে'জ পাবলিশিং-এর নবীন কর্ণধার অপু দের সঙ্গে৷ হ্যাঙ্গারের সাদা সিন্থেটিক আচ্ছাদন, তার নীচে খুপরি খুপরি বইয়ের স্টল, পায়ের নীচে ঘাসের বিকল্প সবুজ রঙের কার্পেট, বদ্ধ পরিবেশ – এটা কি আমাদের চেনা বইমেলা? অপু খুব বিব্রত মুখে স্বীকার করলেন, ‘‘না৷ এটা আমাদের ভালো লাগার বইমেলা নয়৷ মানিয়ে নিতে সকলেরই অসুবিধে হচ্ছে৷ কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না এবার৷'' আর বিক্রিবাটা কেমন? সেটাও যে খুব আশাপ্রদ, তা নয়৷ অপু জানালেন, ‘‘মোটামুটি বিক্রি হচ্ছে৷''
মোদী সরকারের পুরনো নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত এবং বাজারে যথেষ্ট নতুন নোট না থাকার কারণে যে ব্যাপক অসুবিধে হচ্ছে, সেটা বোঝা গেল প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে৷ প্রকাশনা সংস্থা ‘লালমাটি'-র নিমাই গরাই যেমন বললেন, বইমেলার বিক্রি প্রতিবছরই কিছু কিছু করে কমছে, কিন্তু এবার নোট সংকটের কারণে বিক্রি আরও কম৷ নিমাইবাবু লালমাটি-র স্টলে ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটার ব্যবস্থা রেখেছেন, কিন্তু অর্ধেক সময়ই নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না৷ বার বার ‘ট্রানজাকশন ডিক্লাইন্ড' হচ্ছে, ক্রেতারা বিরক্ত হয়ে বই না কিনে চলে যাচ্ছেন৷ অথচ এবার অনেক আগ্রহজনক বই আছে লালমাটির প্রকাশনায়৷ শিশু-সাহিত্যিক স্বপনবুড়োর রচনাসমগ্র বের করেছেন ওঁরা, প্রদ্যুন্ম ভট্টাচার্যের বিখ্যাত বই, বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘টিকা-টিপ্পনি'র ভারতীয় স্বত্ব লালমাটির হাতে৷ সেই বইটি প্রকাশ পেয়েছে৷ সব মিলিয়ে ১৫টা নতুন বই৷ কিন্তু সব আয়োজন পণ্ড হচ্ছে চলতি অর্থ সংকট এবং উপযুক্ত প্রযুক্তি পরিকাঠামো না থাকায়৷
আরেক প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রতিভাস' প্রায় ৪০/৫০টা নতুন বই এনেছে এই বইমেলায়, কিন্তু বিক্রির হিসেব এখনও আশানুরূপ নয়৷ প্রতিভাসের কর্ণধার বীজেশ সাহা আপশোস করলেন, ২৬ জানুয়ারি, সাধারণতন্ত্র দিবসের ছুটির দিনে যেমন ভিড়, যে পরিমাণ বিক্রি প্রতিবার হয়, এবার সেটা হয়নি৷ সুযোগটা হাতছাড়া হয়েছে, কারণ আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের চক্করে আগের দিন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়ে বইমেলা শুরুই হয়েছে এবার ঐ ২৬ তারিখ৷
আর যাঁরা নিয়মিত বইমেলায় যান, বই ভালোবাসেন, তাঁদের বিস্তর অভিযোগ৷ সবথেকে বড় অভিযোগ হলো, বইমেলা তার চরিত্র হারিয়ে ফেলছে৷ ছোট বইয়ের দোকানকে ভরে ফেলা হলো হ্যাঙ্গারের মধ্যে, অথচ মেলায় খাবারের দোকানের ছড়াছড়ি৷ মাছভাজা, কষা মাংস, তিব্বতি মোমো, এছাড়া চা-কফি তো আছেই৷ লেখক সমীর ঘোষ তাঁর ফেসবুক স্টেটাস দিয়েছেন – এবার মেলায় যাব না, কারণ খিদে পাচ্ছে না! আর যাঁরা যাচ্ছেন, তাঁরা অত্যন্ত বিরক্ত রাশি রাশি এঁটো কাগজের প্লেট, গ্লাস, খাবারের ভুক্তাবশেষ মাড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে বলে৷ খাবারের দোকানের সামনে চাকবাঁধা ভিড়৷ বইয়ের দোকানে ঢোকার রাস্তা ঢেকে গেছে এমন ভিড়৷ বহু লোককেই দেখে মনে হচ্ছে, তাঁরা স্রেফ খাবেন বলেই মেলায় এসেছেন! এছাড়াও অনেক বয়স্ক পাঠক অভিযোগ করছেন, মেলায় স্টলের নম্বরের কোনো মাথামুণ্ডু নেই! কিছুই সহজে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ অনর্থক ঘুরতে হচ্ছে৷
সব মিলিয়ে এবারের কলকাতা বইমেলা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ অনেক বেশি৷ এবার নতুন করে আক্ষেপ শোনা গেছে, ময়দানের মাঠে সেই পুরনো বইমেলা কত ভালো ছিল!
আপনি কি কলকাতা বইমেলায় কখনও গেছেন বা এবার যাবেন? জানান আপনার অভিজ্ঞতা, নীচের ঘরে৷