করোনায় পরিকল্পনাহীন শিক্ষা
২৬ মে ২০২১গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়৷ এরপর ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়৷ ১৫ মাস ধরে এই বন্ধে এখন শিক্ষার্থীরা সীমিতভাবে অনলাইন ক্লাশে অংশ নিচ্ছেন৷ বার্ষিক সমাপনী পরীক্ষা হয়নি৷ সীমিত সিলেবাসে এসাইনমেন্ট ভিত্তিক মূল্যায়ন হয়েছে৷ আর এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা পেয়েছেন অটোপাস৷ তবে এবার অটোপাস না দিয়ে সীমিত সিলেবাসে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা নেয়ার চিন্তা করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়৷ আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে ক্লাস নিলেও পরীক্ষা নিতে পারছে না৷ ভর্তি পরীক্ষাও নেয়া সম্ভব হয়নি৷
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি বুধবার এক ভাচুয়াল প্রেস ব্রিফিং-এ বলেছেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে৷ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মত দিলেই খোলার ব্যবস্থা করা হবে৷
গত ডিসেম্বরে জার্মানির ইউনিসেফের প্রেস অফিসার ক্রিস্টিনে কাহমান ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্কুল খোলা রাখার কথা জানিয়ে বলেন, জোর করে স্কুল বন্ধ রাখার কারণে বিশ্ব শিক্ষা সংকটের কবলে পড়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাপী স্কুল বন্ধ করার ফলে শিক্ষা সংকট ছাড়াও আগামী কয়েক দশক ধরে বহু দেশের সমাজে এর প্রতিফলন থাকতে পারে৷ যার পরিণতিতে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হবে শিশুরা, বিশেষ করে প্রান্তিক শিশুরা৷''
ইউনিসেফ-এর গত মার্চের জরিপ বলছে, বিশ্বের যে ১৪টি দেশে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে তার মধ্যে বাংলাদেশ একটি৷ প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন," করোনার দ্বিতীয় বছরেও শিশুরা স্কুলে যেতে পারবে না বা সীমিতভাবে লেখা পড়া করবে এটা গ্রহণ করা যায় না৷ স্কুল খোলাকে এখন সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে৷ এরজন্য পরিকল্পনা করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে৷”
বাংলাদেশে শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদের কথায়ও একই ধারণা পাওয়া যায়৷ তিনি বলেন,"বার বার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণাটিই নেতিবাচক ৷ আমরা শুনতে চাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে এবং কীভাবে খোলা হচ্ছে সেই কথা৷”
তার মতে, শিক্ষা নিয়ে করোনার এই দীর্ঘ সময়ে কোনো সঠিক পরিকল্পনাই করা হয়নি৷ আমরা বলেছিলাম যেভাবেই শিক্ষা চালু রাখা হোক না কেন শিক্ষার্থীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক রেখে করা হবে৷ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানের কোনো উন্নতি হয়নি৷ অনলাইন গতানুগতিক৷ আর অটোপাস দেয়া হচেছ৷ ফলে এই শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে৷ আমরা যদি শুরু থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিকল্পনা করতাম তাহলে হয়তো এখন স্কুল খোলা যেত৷ অটোপাস দিতে হত না৷ সব খাতে প্রণোদনা দেয়া হল৷ এই খাতে নাই৷
তিনি বলেন," শিশুরা স্কুলে না যাওয়ায় এখন প্রতিদিন অভিভাবকদের তিন কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়৷ চার কোটি স্কুলগামী শিশুর জন্য ১২ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হচেছ৷ এটা নিয়েও কোনো পরিকল্পনা হয়নি৷”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানের সাথে কোনা আপোস করা যাবে না৷ সেটা করা হলে এই করোনায় তারা যতটা পিছিয়ে পড়বে তা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে৷ আর ইন্টারনেট ও ডিভাইস সবার হাতে না থাকায় অনলাইন শিক্ষায় সবাই অংশ নিতে পারছে না ৷ গ্রামের স্কুলের শিক্ষার্থী এবং কম আয়ের পরিবারের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে৷ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও একই অবস্থা৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুজিবর রহমান বলেন," আমরা ছোট ছোট পাইলট প্রকল্প করে দেখতে পারতাম স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল খোলা যায় কি না৷ শহরে একটু সমস্যা হলেও গ্রামে কিন্তু পরীক্ষা নেয়া যেত৷ শহরেও একটু পরিকল্পনা করে পরীক্ষা নেয়া অসম্ভব ছিল না৷ করোনা যদি বিদায় না নেয় তাহলে আমাদের প্রস্তুতি কী?”
শিশুদের এখন যে অনলাইন ক্লাস হচ্ছে তাতে চাইল্ড সাইকোলিস্ট-এর পাঠ থাকা খুবই জরুরি মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন৷ তিনি বলেন," করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের মানসিক সমস্যা চার থেকে আট গুণ বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ শিশুদের জন্য সারা বিশ্বে এখন ব্যাক টু স্কুল প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে৷ আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের সেই উদ্যোগ নেয়া উচিত৷”
তার মতে এই শিশুদের যদি প্রস্তুত করা যায় তাহলে নিও নরমাল বিশ্বে তারাই নেতৃত্ব দেবে৷ কিন্তু আমাদের সেই পরিকল্পনা নেই৷ তাই শিক্ষার্থীরা উল্টো ক্ষতির মুখে পড়তে পারে৷