1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

করোনা রাজনীতিতে হচ্ছে না টেস্ট

স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
১৭ এপ্রিল ২০২০

পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজারে ০ দশমিক ৫ জনের করোনা টেস্ট হচ্ছে। পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট, রোগ ধরা পড়ছে না।

https://p.dw.com/p/3b3No
ছবি: DW/S. Bandopadhyay

লকডাউন সত্ত্বেও ভারতের করোনা সংক্রমণ ক্রমশ বাড়ছে। অভিমত বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসকদের। সরকারি হিসেবেও তা পরিষ্কার। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা কি তার চেয়ে অনেক বেশি? বিশেষজ্ঞ মহল বার বার সে প্রশ্ন তুলছে। তাঁদের অভিযোগ, দেশে এখনও পর্যন্ত ঠিক মতো করোনা পরীক্ষাই হচ্ছে না। এবং সেই তালিকায় সবার উপরে পশ্চিমবঙ্গের নাম। বস্তুত, করোনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি চলছে বলেই বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য।

প্রথমেই চোখ রাখা যাক পরিসংখ্যানে। দিন তিনেক আগের তথ্য বলছে, রাজধানী দিল্লিতে প্রতি ১০ হাজারে পরীক্ষা হচ্ছে ৭ জনের। আগামী কয়েক দিনে তা আরও বাড়ার কথা। কেরালায় পরীক্ষা হচ্ছে ১০ হাজারে সাড়ে চার জনের। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে পরীক্ষা হচ্ছে একজনেরও কম। ১০ হাজারে ০ দশমিক ৫ জনের।

কেন পশ্চিমবঙ্গের এই বেহাল দশা? দীর্ঘ দিন ধরেই রাজ্য সরকার দাবি করছিল কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যে পরিমাণ মতো টেস্ট কিট পাঠাচ্ছে না। অথচ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) এর বক্তব্য রাজ্যে যথেষ্ট পরিমাণ কিট দেওয়া হয়েছে। কলকাতার আইসিএমআর-নাইসেডের প্রধান শান্তা দত্তের বক্তব্য, ''কিট কম আছে, এ কথা আর বলা যায় না। এই মুহূর্তে আমাদের হাতে ২৭ হাজার ৫০০ কিট আছে। বস্তুত, করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকে কখনওই আমাদের কিটের অভাব ঘটেনি। কিন্তু সরকার হাসপাতালগুলি থেকে নমুনা পাঠাচ্ছে না। আমার ধারণা, এখানে পরীক্ষা ঠিক মতো হচ্ছে না বলেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এতটা কম।'' শান্তা দত্ত জানিয়েছেন, বাকি দেশে যে ভাবে করোনা ছড়িয়েছে, তার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো কম। অথচ জনঘনত্বের বিচারে এখানে সংক্রমণ অনেক বেশি হওয়ার কথা। ফলে ধারণা করা যেতেই পারে যে, পরীক্ষা হচ্ছে না বলে সংখ্যাটা কম। নাইসেডের বক্তব্য, সপ্তাহখানেক আগেও যেখানে তারা দিনে ৮০ থেকে ৯০ টি করে নমুনা পাচ্ছিলেন, গত কয়েক দিনে তা কমে ২০-র নীচে নেমে গিয়েছে।

শান্তা দত্তের দাবিকে মান্যতা দিচ্ছেন রাজ্যের চিকিৎসকদের একাংশ। প্রকাশ্যেই তাঁরা বলছেন, রাজ্যে যথেষ্ট পরীক্ষা হচ্ছে না। চিকিৎসক কুনাল সরকার এ বিষয়ে একাধিকবার তাঁর বক্তব্য সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। বিশিষ্ট চিকিৎসক সমরজিৎ জানা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''পরীক্ষা হচ্ছে না, তা স্পষ্ট। সংখ্যা চেপে রেখে এক ধরনের রাজনীতি হচ্ছে। কিন্তু এতে রাজ্যেরই ক্ষতি হচ্ছে। সংক্রমণ কতটা ছড়াচ্ছে, তা বোঝাই যাচ্ছে না। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের তরফ থেকে সরকারকে চিঠিও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও কোনও লাভ হয়নি।'' চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, তৃণমূল সরকার চিকিৎসকদের পরামর্শও শুনছে না। কিছু দিন আগে মুখ্য সচিবকে দিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করিয়ে রাজ্যে করোনা রোগীর সংখ্যা পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ঠিক কী ঘটছে পশ্চিমবঙ্গে? কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে পরিস্থিতি। দিন কয়েক আগে বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে দুই জন রোগী শ্বাসকষ্টনিয়ে ভর্তি হন। আইসোলেশন ওয়ার্ডে তাঁদের ভর্তি করা হলেও করোনার পরীক্ষা হয়নি। এরপর মেডিকেল কলেজেই তাঁদের মৃত্যু হয়। তাঁদের করোনা রোগী বলে শনাক্ত করা না হলেও মৃতদেহ পরিবারের হাতে দেওয়া হয়নি। ওই রাতেই তড়িঘড়ি করে মৃতদেহ দু'টি পোড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। পরিবারকেও কোয়ারান্টিনে পাঠানো হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য জানিয়েছেন, মৃত দুই ব্যক্তির লালারস সোয়াব পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তার রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।

খাস কলকাতাতেও এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করার পরে করোনার পরীক্ষা হচ্ছে না বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরাই। অথচ রোগীর মৃত্যুর পরে সেই মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে না বহু ক্ষেত্রেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর পরে পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে যে তাঁর শরীরে করোনার সংক্রমণ ঘটেছিল। কলকাতার আর জি কর, মেডিকেল কলেজ, এন আর এস-- প্রতিটি হাসপাতালেই এমন ঘটনা ঘটেছে। জেনারেল, মেডিসিন, গায়নেকোলজিকাল ওয়ার্ডে রোগীর মৃত্যুর পরে জানা গিয়েছে তাঁদের করোনা সংক্রমণ ঘটেছিল। ফলে সাময়িক সময়ের জন্য সেই ওয়ার্ডে রোগী নেওয়াই বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সমস্যায় পড়েছেন সাধারণ রোগীরা। এমনই এক মৃতের পরিবারের বক্তব্য, ''হাসপাতালকে আমরা বার বার করোনা টেস্টের জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গরিমসি করছিলেন। সাধারণ চিকিৎসাও করা হচ্ছিল না। বহু রোগী এ ভাবেই বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন।''

পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলি এ বিষয়ে সরাসরি সরকারের দিকে আঙুল তুলেছে। অভিযোগ, করোনা তথ্য চাপার চেষ্টা করছে তৃণমূল সরকার। সে কারণেই করোনার পরীক্ষা হচ্ছে না। বামেরা কেরালার উদাহরণ টেনে বলছেন, সেখানে টেস্ট হচ্ছে বলে রোগের চিকিৎসাও হচ্ছে। মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারছেন। পরিসংখ্যান বলছে তামিলনাড়ু, কেরালা এবং দিল্লিতে দেশের মধ্যে সব চেয়ে বেশি টেস্ট হচ্ছে। ফলে সেখানে রোগীর সংখ্যাও বেশি।

তৃণমূলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও ব্রায়েন এই অভিযোগের জবাব দিয়ে বলেছেন, ''৩১ মার্চ পর্যন্ত রাজ্য মাত্র ৪০টি কিট পেয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত, কিট দেবে কেবলমাত্র আইসিএমআর। তাদের কাছেও বেশি কিট ছিলো না। যে সব রাজ্যে করোনা প্রবল আকার নিয়েছে, সেখানে তারা আগে কিট পাঠিয়েছে। সম্প্রতি ৭০ লাখ কিট বিদেশ থেকে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। সেই কিট আসতে শুরু করেছে। বাংলার অপরাধ হলো, তারা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিল, তাই বাংলায় করোনা কম হয়েছে। কিটও তারা কম পেয়েছে। আর রাজ্যে বিরোধীরা নিয়মিত মিথ্যা অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছেন। দয়া করে করোনা-রাজনীতি করবেন না।''

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, শুধু পশ্চিমবঙ্গকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ১৩৭ কোটির ভারতে টেস্ট হচ্ছে না বললেই চলে। ১০ লাখে টেস্ট হচ্ছে মাত্র ১৮ জনের। যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ছোট দেশে প্রতি ১০ লাখে টেস্ট হয়েছে ছয় হাজার ৯১ জনের। যদিও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দাবি, গত কয়েক দিনে টেস্টের মাত্রা অনেক বাড়ানো হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোকের পরীক্ষা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বক্তব্য, তারাও আইসিএমআর এর নিয়ম মেনেই পরীক্ষা করছে। কিন্তু চিকিৎসকদের বক্তব্য, কেন্দ্র এবং রাজ্য সকলেই আসলে রোগীর সংখ্যা চাপতে চাইছে। কেউই ঠিক মতো পরীক্ষা করছে না। ঠিক সংখ্যাও জানাচ্ছে না।

সমরজিৎ জানার মন্তব্য, ''টেস্ট না হলে এই লকডাউনের কোনও মানে নেই। কারণ টেস্ট না হলে বোঝাই যাবে না কোথায় সংক্রমণ ছড়ালো।'' চিকিৎসক পার্থপ্রতিম বসুও সমরজিৎ জানার সঙ্গে এক মত। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''এখন রাজনৈতিক তরজা করার সময় নয়। পরীক্ষার কোনও বিকল্প নেই। ফলে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে বিতর্ক বন্ধ করে যত বেশি সম্ভব টেস্ট করতে হবে। বিশেষ করে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, করোনায় যাঁরা পরিষেবা দিচ্ছেন সেই দোকানদার, বাড়িতে জিনিস পৌঁছে দেওয়ার লোক, সবজি, ফল বিক্রেতা এবং যাঁদের মধ্যে সামান্যতম রোগলক্ষণ আছে তাঁদের। দ্রুত টেস্ট হওয়া খুবই জরুরি।''

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷