করোনা ভাইরাসের ভাইরালে গণমাধ্যম
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০গণমাধ্যমের কাছে এমন পরিস্থিতি মানেই সংবাদের খনি৷ সেখান থেকে কে, কত ভাবে কত ধরনের সংবাদ কত দ্রুত পরিবেশন করতে পারে চলে তার অবিরাম প্রতিযোগিতা৷
বাংলাদেশে এখনও এই ভাইরাস ছড়ানোর কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি, কিন্তু মানুষের মধ্যে আতঙ্ক যে ছড়িয়েছে তা বলা যায়৷ বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতির প্রভাব সবার আগে পড়ে বাজারে৷ গত বছর ডেঙ্গু রোগের বিস্তারে অ্যারোসোল থেকে শুরু করে মশানাশক যত পণ্য তার দাম গগণচুম্বি হতে সময় লাগেনি৷ ক্রেতারা উঠেপড়ে সেগুলো যার যার সাধ্যমত মজুদ করেছেন ঘরে৷ এবার প্রভাব পড়েছে মাস্কের বেচাকেনাতে৷ মুখোশ জড়িয়ে কেউ কেউ উহান ফেরতদেরও দেখতে গিয়েছিলেন বিমানবন্দর সড়কে৷ তাদের নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস যখন আশকোনার হজ্জ ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছিল রাস্তার পাশে অনেকেরই ছিল কৌতূহলী দৃষ্টি৷ মুখে মাস্ক পরে অনেককেই নাক চেপে থাকতেও দেখা গেছে ফেসবুকে ছড়ানো ছবিতে৷ মানুষের এত ‘সতর্কতা' তা গণমাধ্যমের বদৌলতেই৷
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন একদিকে মূল ধারার গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যদিকে সহযোগী৷ কোথায় মানুষের আগ্রহ তা বোঝার মানদণ্ড হয়ে উঠেছে ফেসবুক৷ আবার ফেসবুকের ভাইরাল হওয়া তথ্যও সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরের উৎস হয়ে ওঠে৷ অতি উৎসাহী সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকেই ইন্টারনেট ঘেটে নিজেরাই নানা খবর তৈরি করেন৷ সহজে ক্লিক, ভিউ পাবার আশায় সেসব ভাইরাল ‘খবর' অনেক সংবাদ মাধ্যম বিশেষ করে অনলাইন র্পোটালে জায়গা করে নেয়৷
ঠিক এমনটাই ঘটতে শুরু করেছে করোনা ভাইরাস নিয়েও৷ এই ভাইরাসের উৎস কী, কিভাবে ছড়ালো তা নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে চীনের মানুষের খাবার দাবার নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ৷ কেউ বলে দিচ্ছেন বাদুড়ের স্যুপ খেতে গিয়ে চীনের মানুষের শরীরে এসেছে এই ভাইরাস, কেউ মন্তব্য করছেন দেশটির মানুষের সাপ খাওয়ার অভ্যাস থেকেই ছড়িয়েছে রোগটি৷ চীনের নাগরিকরা কী খায় তা নিয়ে ইন্টারনেটে ছড়ানো ছবি দিয়ে সচিত্র প্রতিবেদনও প্রচার করেছে দেশের কিছু টেলিভিশন চ্যানেল৷ তারই ধারাবাহিকতায়, ‘উপজাতীয়রা সাপ খায়, তাহলে কি দেশেও ছড়াবে করোনা ভাইরাস?', এমন শিরোনামে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনও দেখলাম ফেসবুকে এক আদিবাসী বন্ধুর শেয়ারে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে এই গড্ডালিকা প্রবাহ যে বর্ণবাদি আচরণ উসকে দিতে পারে গণমাধ্যমের সেটিও ভাবার দায়িত্ব রয়েছে৷
মুসলিম ধর্মাবলম্বী উইগুরদের উপর চীনের নীপিড়ন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রায়ই শিরোনাম হয়৷ অতিলৌকিক শক্তির প্রদত্ত শাস্তি হিসেবেই দেশটিতে এখন করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে, ফেসবুকে নিজেদের এমন বিশ্বাসের কথা প্রচার করছেন অনেকে৷ এ নিয়ে চীনের প্রেসিডেন্টের একটি পুরাতন ভিডিও নতুন করে ভাইরাল হয়েছে৷ যেখানে দেখা গেছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মসজিদ পরিদর্শন করছেন৷ এটি ২০১৬ সালের ছবি৷ নিংচিয়া রাজ্যের মুসলিম ধর্মাবলম্বী হুন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলেন তিনি৷ কিন্তু বাংলাদেশে ফেসবুকে অনেকে ভিডিওটি এই বলে শেয়ার করছেন যে, করোনা ভাইরাসের প্রেক্ষিতে উইগুরদের মসজিদে গিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট নাকি নামাযও পড়েছেন৷ অবাক করা বিষয় হল এ নিয়ে বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল ‘মসজিদে গিয়ে দোয়া চাইলেন চীনা প্রেসিডেন্ট' এমন শিরোনামে প্রতিবেদন করেছে৷
সংক্রামক যেকোনো রোগের বিস্তার ঠেকানোর ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থাকে৷ কারণ সঠিক তথ্যটি দ্রুত মানুষের কাছে পৌছানোটা জরুরি৷ একটা সময়ে কলেরা বা ডায়রিয়ায় মানুষের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক ঘটনা৷ কিন্তু সহজ, স্বল্পমূল্যের সমাধান ওরস্যালাইনের কথা এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষটিও জানেন৷ নাগরিকদের সচেতন করার মাধ্যমে পোলিও, পক্স, প্লেগসহ বিভিন্ন রোগের বিস্তারও ঠেকানো গেছে বাংলাদেশে৷ সেখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না৷
শুধু সাধারণ মানুষ নয় বাংলাদেশে গণমাধ্যমকে সরকারের টনক নড়ানোর জন্যেও তৎপর হতে হয়৷ ডেঙ্গু রোগের প্রকোপের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছে৷ ভাইরালের পেছনে না দৌড়ে গণমাধ্যম সংবাদের ক্ষেত্রে সেই যথাযথ ভূমিকাটুকুই পালন করুক৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷