দুই কবির মরণোত্তর বিচার?
২৭ এপ্রিল ২০১৬কিছু বললে বা লিখলেই ‘অনুভূতিতে আঘাত', ‘অনুভূতিতে আঘাত' মিছিল করে যদি হাজার মানুষ ছুটে যেত, ‘বিদ্রোহী' কবিতার জন্য বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের তখন কী দশা হতো? মানবপ্রেমে উদ্বুধ কবি শেখ ফজলল করিমেরও কি তাহলে কট্টর ইসলামপন্থিদের নাঙা তলোয়ার বা চাপাতির মুখোমুখি হতে হতো না?
হ্যাঁ, বাগেরহাটের চিতলমারীর হিজলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ মহলী ও গণিতের শিক্ষক অশোক কুমার ঘোষালের বিচার প্রসঙ্গেই নজরুল এবং ফজলুল করিমকে টেনে আনলাম৷ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে ভ্রাম্যমাণ আদালত বাগেরহাটের ঐ দুই শিক্ষককে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে৷
অতি দ্রুত বিচার করেছে আদালত৷ এ কারণে বিচারককে ধন্যবাদ৷ প্রশাসনকেও অশেষ ধন্যবাদ৷ কত চোর-ডাকাত-খুনি-বদমাশের বিচার হয় না৷ বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে কেঁদে মরে৷ কিন্তু দু'জন শিক্ষকের বিচার হয়েছে দ্রুত ৷ ব্রিটিশ আমলের আইন আছে৷ সে আইনে আধুনিক বিশ্বের ডিজিটাল বাংলাদেশের বাগেরহাটের দু'জন শিক্ষকের বিচার হয়েছে৷
আমি বিচার মানি, তালগাছও মানি৷ খবরে পড়েছি, ওই দুই শিক্ষকের একজন স্কুলে গণিত পড়ান৷ বিজ্ঞান ক্লাসে ছাত্রদের প্রশ্নের জবাবে তিনি ধর্মীয় বিষয়ে কথা বলেছিলেন৷ তাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে৷ কয়েকজন ছাত্রই শিক্ষকের বিচার চাইতে ছুটে যায় প্রধান শিক্ষকের কাছে৷ প্রধান শিক্ষকের বিচার নিশ্চয়ই ছাত্রদের মনঃপুত হয়নি৷ সেকারণেই বহিরাগতদের নিয়ে প্রধান শিক্ষককে প্রহার এবং তাঁকে আটকে রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷
তারপর দ্রুত বিচার আদালত শত শত মানুষের উপস্থিতিতে যে রায় দিয়েছে তা নিশ্চয়ই যৌক্তিক এবং গণতান্ত্রিক৷ রায়টি নিশ্চয়ই উপস্থিত শত মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবি পূরণ করেছে, পরিস্থিতিও আপাতদৃষ্টিতে শান্ত হয়েছে৷
আমি গণতন্ত্র মানি৷ জানি সরব এবং আগ্রাসি সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপের মুখে সংখ্যালঘুর সব জ্ঞান অসার, সব মুর্খতা পাপ৷
বাগেরহাটের ওই স্কুলে গণিতের শিক্ষক বিজ্ঞান পড়ান৷ বেশ৷ বিজ্ঞানের ক্লাসে ছাত্র ধর্মীয় বিষয়ে প্রশ্ন করে৷ বেশ, বেশ, বেশ৷ কিন্তু দেশে যখন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে মানুষ হত্যা প্রায় ‘জায়েজ' হয়ে গেছে তখন তিনি ধর্মীয় বিষয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবেন কেন? মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে পারলেন না? নিজের বয়স, জ্ঞান-বিজ্ঞান সব ভুলে করজোরে ছাত্রদের বলতে পারলেন না, ‘আমাকে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করো না৷ আমি কোনো ধর্মগুরু নই৷''
যদি দিতেই হয় তাহলে সেই উত্তর দিতে হবে কবি শেখ ফজলল করিমের কবিতা দিয়ে৷ বিজ্ঞান ক্লাসে পড়াতে হবে কবিতা৷ সেই কবিতায় শুধু বেহেশত বা স্বর্গ নয়, দোজখ বা নরক সম্পর্কেও ধারণা দেয়া আছে৷ কবিতার নামই ‘স্বর্গ ও নরক'৷ সেখানে শেখ ফজলল করিম লিখেছিলেন,
‘‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর?
মানুষেরই মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর!
রিপুর তাড়নে যখনই মোদের বিবেক পায় গো লয়,
আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনি পুড়িতে হয়৷
প্রীতি ও প্রেমের পূণ্য বাঁধনে যবে মিলি পরষ্পরে,
স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরি কুঁড়ে ঘরে৷''
বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে কি মনে হয় ধর্মীয় বিষয়ে মন খুলে কথা বললে কারো পৃথিবীটা দোজখ হয়ে যেতে সময় লাগবে?
অবশ্য শেখ ফজলল করিমের ‘মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক' কথাটাও অনেকের অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে৷ বাংলাদেশে এখন এমন কবিতা লিখলে কবিকে একটি মহল হয়ত ‘নাস্তিক' বলে তাঁর ফাঁসিও দাবি করত৷ কোরআনের ব্যখ্যা উল্লেখ না করে তিনি যে মানবিক দর্শনে স্বর্গ আর নরকের ঠিকানা বলেছেন সেই অপরাধে তাঁকে হত্যার হুমকিও হয়ত দেয়া হতো৷ ভাগ্যিস, শেখ ফজলল করিম ১২৮৯ বঙ্গাব্দে লালমনিরহাটে জন্ম নিয়ে বহু আগে মারাও গেছেন৷ বেঁচে থাকলে লালমনিরহাটের করিম সাহেব বাগেরহাটের ঘটনা শুনে নিশ্চয়ই আঁতকে উঠতেন!
ধর্মের নামে উগ্রতা খুব বেড়েছে৷ হঠাৎ বাড়েনি, অনেক দিন ধরেই বাড়ছে৷ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আগে যতটা ছিল, ততটা নেই৷ শাহ আব্দুল করিম তাঁর গানে কবেই লিখে গেছেন, ‘‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম...৷''
সুন্দর দিনের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন,
‘‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
...
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম
বর্ষা যখন হইত,
গাজির গান আইত,
রংগে ঢংগে গাইত
আনন্দ পাইতাম৷৷''
তবে রাজনীতি সেই সম্প্রীতি অনেকটাই নষ্ট করেছে৷ সে কথাও ইঙ্গিতে লিখে গেছেন বাউল সাধক৷ শাহ আব্দুল করিম একই গানে লিখেছেন,
‘‘কে হবে মেম্বার,
কে বা গ্রাম সরকার
আমরা কি তার খবরও লইতাম?
হায়রে আমরা কি তার খবরও লইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম৷''
কিন্তু সেই দিন আর নেই৷ এমন হতাশা থেকে শাহ আব্দুল করিম সেই গানের শেষেই লিখেছেন,
‘করি ভাবনা/ সেই দিন আর পাব নাহ...''
শেষ কথা:
যারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে শিক্ষককে পেটালো তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো মামলা হয়েছে? কেন হয়নি? পিটুনিতে শিক্ষকের গায়ে এবং অনুভূতিতে কি আঘাত লাগেনি?
হামলাকারীদের বিরুদ্ধেও মামলা হোক, তাঁদেরও বিচার হোক৷ নইলে কবিতায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার নামে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং কবি শেখ ফজলুল করিমের মরণোত্তর বিচার শুরু হোক৷