যক্ষ্মা রোগ
১০ নভেম্বর ২০১২গত কয়েক বছর ধরে টিবি বা যক্ষ্মা রোগের বিস্তার আবারো লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও এ রোগ কাবু করা যাচ্ছে না৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ডাব্লিউএইচও'র রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ৪ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারাত্মক যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত, যেগুলিকে নানারকমের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েও আয়ত্তে আনা সম্ভব হচ্ছে না৷
১০ বছর ধরে দারিয়া অচেরেট লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে মাদকাসক্তদের দেখাশোনা করছেন৷ আগে কখনও যক্ষ্মা রোগটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাননি তিনি৷ কিন্তু ইদানীং একটি প্রবণতা দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন দারিয়া ও তাঁর সহকর্মীরা৷ দারিয়ার ভাষায়, ‘‘অনেক বছর ধরে পূর্ব-ইউরোপে বহু মাদকাসক্ত ব্যক্তি মারা যেতেন অতিরিক্ত মাদক সেবন করে৷ কিংবা আত্মহত্যাও করতেন অনেকে৷ গত দুই বছর ধরে অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ আমরা আজ যেসব মাদকাসক্তদের দেখাশোনা করছি, তাঁদের বেশিরভাগই মারা যাচ্ছেন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে৷''
পূর্ব ইউরোপে যক্ষ্মার প্রকোপ
পূর্ব-ইউরোপ বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই যক্ষ্মা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও'র তথ্য অনুযায়ী, এই এলাকায় ৮০ হাজার মানুষ মারাত্মক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত৷ এই রোগের জীবাণুগুলিকে প্রচলিত ওষুধ দিয়ে ঘায়েল করা সম্ভব হচ্ছে না৷ পূর্ব-ইউরোপের ১৫টি দেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত৷ এর মধ্য রয়েছে রাশিয়া, বেলারুশ, বুলগেরিয়া, মলডেভিয়া৷ পর্যটকদের মাধ্যমে জার্মানিতেও রোগটি এসে পড়ছে৷ জানান রবার্ট কখ ইনস্টিটিউটের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বারবারা হাউয়ার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আমরা জার্মানিতে যক্ষ্মা রোগীদের মধ্যে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণুর বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি৷ আমাদের অপেক্ষা করে দেখতে হবে, অন্যান্য দেশে কীভাবে রোগটি বিস্তৃত হচ্ছে৷ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় জার্মানিতে এখনও এই রোগের প্রকোপ অনেক কম৷ বছরে ৫০টি ঘটনার কথা জানা গেছে৷ তবুও সংখ্যাটা একেবারে অগ্রাহ্য করার মতো নয়৷''
যক্ষ্মা রোগে বহু ওষুধ
যক্ষ্মা রোগীরা সাধারণত চার থেকে পাঁচ ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক পেয়ে থাকেন, যা তাঁদের ছয় মাস ধরে নিতে হয়৷ রোগীরা এই নিয়ম মেনে না চললে বা ওষুধ ছেড়ে দিলে ব্যাকটেরিয়াগুলি ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে পড়ে৷ এই রকম অবস্থায় চিকিত্সা করতে গেলে দৈনিক ১৭টি পর্যন্ত ট্যাবলেটের প্রয়োজন হতে পারে৷ সেই সাথে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও খরচ তো রয়েইছে৷ যা সাধারণ যক্ষ্মা চিকিত্সার চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি হতে পারে৷ এছাড়া আরোগ্যের সম্ভাবনাও নিশ্চিত করে বলা যায় না৷ এক্ষেত্রে প্রয়োজন নিবিড় পর্যবেক্ষণের৷ এই প্রসঙ্গে ডাব্লিউএইচও'র ইউরোপ দপ্তরের আন্দ্রেই ডাদু বলেন, ‘‘ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর হার তেমন বেশি নয়৷ কিন্তু আমরা রোগীদের খবর না জানলে তাঁরা অন্যদেরও সংক্রমিত করতে পারেন৷ আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলিতে আরো বেশি করে রোগ শনাক্তকারী কারিগরি সহায়তা দিতে হবে, যাতে তাঁরা সহজেই ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা নির্ণয় করতে পারেন৷''
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অর্থ বরাদ্দ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১১ সালে ৪০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ইউরোপের যক্ষ্মা রোগের ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলির জন্য বরাদ্দ করেছে৷ এর মধ্যে রয়েছে দ্রুত জীবাণু শনাক্তকারী যন্ত্রপাতি৷ এর মাধ্যমে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জীবাণুর ডিএনএ বিশ্লেষণ করা সম্ভব৷ ২০১৫ সালের মধ্যে এই খাতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাজেট ২ বিলিয়নে উন্নীত করা হবে৷
এছাড়া রোগটির সুচিকিত্সার জন্য হাসপাতালের বেড ও উপযুক্ত গবেষণাগারেরও প্রয়োজন৷ কেননা পরীক্ষা করে দেখা দরকার, কোন ওষুধ রোগীর কাজে লাগছে৷ দারিয়া অচেরেটের মতে, এক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতাও জাগাতে হবে৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘রাশিয়ায় গত কয়েক বছরে যে সব যক্ষ্মা রোগী মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এইচআইভি ভাইরাসে সংক্রমিত ও মাদকাসক্ত৷ তাই এটা সহজেই বোঝা যায়, কেন এই সব মানুষের চিকিত্সা করা হয়নি৷ দেশটিতে মাদকদ্রব্য বেআইনি৷ তাই মাদকাসক্তরা জেলে যাওয়ার ভয়ে ডাক্তারের কাছেও যেতে চান না৷ হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও মাদকের কোনো বিকল্প না দিয়ে ছয় মাসের জন্য রেখে দেয়া হয় রোগীদের৷ তাই অনেকেই পালিয়ে যান৷ কিংবা মাদকসহ ধরা পড়লে তাঁদের বের করে দেয়া হয়৷ এইভাবে চিকিত্সায় বাধা পড়ে এবং ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার ঝুঁকি ও বিস্তারের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়৷''
সচেতনতা বৃদ্ধি করা
মাদকাসক্তদের যক্ষ্মায় চিকিত্সায় সম্পৃক্ত করা যায় কিন্তু অনায়াসেই৷ যেমন যে সব মাদকসেবী নিয়মিত মাদকের বিকল্প মেথাডন নিতে হাসপাতালে আসেন, তাঁদের টিবির ওষুধও দেয়া যেতে পারে৷ কিন্তু এই ধরনের চিন্তাভাবনা সোভিয়েত আমলের স্বাস্থ্যসেবা কাঠামোর আবর্তে মার খেয়ে যাচ্ছে৷ ইউক্রেন, রাশিয়া, বেলারুশ এবং আজারবাইজান ও কাজাখিস্তানেও যক্ষ্মার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা যায়৷ তবে রোগটিকে রুখতে হলে শুধু সরকারি সহায়তা নয়, প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতারও৷